আজকাল লম্বা শারীরিক গঠনের কদর খুবই বেশি। কিন্তু সবাই তো আর লম্বা ও সুগঠিত শরীর নিয়ে জন্ম নেন না। সেজন্য অনেকেই লম্বা হওয়ার প্রচুর চেষ্টায় থাকেন। কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ নিয়ে মাতামাতি করেন। আবার অনেকেই লম্বা হতে না পেরে হতাশা আর বিষণ্ণতায় পড়ে যান। তবে, হতাশ হওয়ার আর কোনো কারণ নেই। কেননা, আজকের লেখায় আলোচনা করব- ঘরোয়া এবং প্রাকৃতিক উপায়ে লম্বা হওয়ার সহজ উপায় সম্পর্কিত কিছু টিপস নিয়ে।
দেহের উচ্চতা বাড়া বা কমা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্ভর করে আমাদের বয়সের গণ্ডির ওপর। শরীরতত্ত্ববিদদের মতে, ‘মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৬ আর ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর বয়সের পর লম্বা হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা কম থাকে, এবং ২৫ এর পর গ্রোথ বন্ধ হয়ে যায়।
এক্ষেত্রে কিছু সচেতনতা এবং বিষয়াদি মেনে চললে, বেশ স্বাভাবিক ভাবেই উচ্চতা থেমে না থেকে বয়সের সঙ্গে সমান তালে বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে এগুলো কিন্তু রাতারাতি কাজ করবে না।
দীর্ঘ দিন আপনাকে ধৈর্য ধরে মেনে চলতে হবে। তবেই মিলবে সন্তোষজনক ফল।
তাহলে চলুন আলোচনা করা যাক, ঘরোয়া এবং প্রাকৃতিক উপায়ে লম্বা হওয়ার সহজ কিছু উপায় সম্পর্কে।
লম্বা হওয়ার সহজ উপায়
১. নিয়মিত কিছু নির্দিষ্ট ব্যায়াম করা
উচ্চতা বাড়াতে চাইলে ব্যায়াম করতেই হবে। কেননা, নিয়মিত ব্যায়াম লম্বা হওয়ার উপায় হিসাবে দারুণ কার্যকারী। এজন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০ মিনিট ব্যয়াম করা উচিত।
নিয়মিত ব্যায়াম দেহে ওজন উদ্ধরণ (HGH) হরমোন নিয়ন্ত্রনে বিশেষ ভুমিকা পালন করে। এই হরমোনের কাজ অস্থি ও তরুনাস্থির দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করা এবং শর্করা, প্রোটিন ও ফ্যাট বিপাকে সাহায্য করা।
উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য দেহে সঠিক মাত্রার HGH হরমোন থাকা যেমন জরুরি তেমনি এই হরমোনের কম ক্ষরণে বামনত্ব বা ডোয়ারফিজম এবং অধিক ক্ষরণে অতিকায়ত্ব বা জাইগ্যানটিজম (বেশী লম্বা হওয়া) রোগ হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকে।
কাজেই দেহে HGH এর মাত্রা ঠিক রাখতে এবং বয়সের সাথে তালে তাল মিলিয়ে লম্বা হতে চাইলে নিয়মিত কিছু নির্দিষ্ট ব্যয়াম করা অত্যান্ত জরুরি।
আরও পড়ুন-
প্রাকৃতিক ভাবে লম্বা হওয়ার উপায় হিসেবে যে ব্যায়াম গুলো কার্যকর
সাঁতারঃ শুধু অভ্যন্তরীণ ভাবেই নয়, বাহ্যিক ভাবেও শরীরের জন্য পানি খুবই প্রয়োজনীয়। সাঁতার কাটলে শরীর ফ্লেক্সিবল তো হয়ই, সেই সঙ্গে পেশীগুলোও প্রসারিত হয়, এভাবেই ধীরে ধীরে দেহের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। কাজেই, প্রাকৃতিক ভাবে লম্বা হওয়ার অন্যতম একটি উপায় হল সাঁতার।
কোবরা পোজঃ এটি মূলত ইয়োগার একটি পর্যায়, তবে অনেকটা সাপের মতন মাথা উঁচু করে এই ব্যয়াম করতে হয় বলে এটি ‘কোবরা পোজ’ নামে পরিচিত। প্রথমে পেটের উপর চাপ দিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ুন, তারপর হাতের তালুতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে শরীরের উপরের অংশ উঁচু করুন। এ ব্যায়ামের মাধ্যমে আপনার পেশীগুলোর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে আরো একটু বেশি, যা আপনাকে প্রাকৃতিকভাবে লম্বা হতে বেশ সাহায্য করবে।
দড়ি লাফঃ সব বয়সের মানুষের খুব প্রিয় এবং বেশ মজার একটি খেলা হল দড়ি লাফ। আর উচ্চতা বাড়াতেও এই খেলা বেশ কার্যকারী
দড়ি লাফ খেলার জন্য ক্রমাগত লাফ দিতে হয়। এতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরো শরীরের ব্যায়াম হয়। ফলে শরীরের প্রতিটি পেশী সক্রিয় হয়ে যায়। আর হ্যা, এই খেলা দেহের ওজোন নিয়ন্ত্রনেও কিন্তু দারুণ সহায়ক।
২. তীব্র Sprinting ব্যায়াম
যে কোনো কঠিন শারীরিক ব্যায়ামকেই তীব্র Sprinting ব্যায়াম বলা হয়। নিয়মিত এই ব্যায়াম করলে মানবদেহের বৃদ্ধির জন্য দায়ী হরমোনের একটি বিস্ফোরণ ঘটে, যা দেহের উচ্চতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তবে, নিশ্চয়ই সেটা ২১বছর বয়স হওয়ার পর।
৩. নিয়মিত দুধ পান
প্রোটিনের একটি ভাল উৎস হল দুধ। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, দুধে একাধিক পুষ্টিকর উপাদান উপস্থিত থাকায় নিয়মিত দুধ পানে দেহের উচ্চতা বাড়বেই।
দুধের সঙ্গে লম্বা হওয়ার সম্পর্ক যে কোতটা নিবিড়, তা নেদারল্যান্ডের নাগরিকদের দেখলেই প্রমাণ পাওয়া যায়। জানা যায়, ডাচেরা সারাদিনে আর কিছু খাক বা না খাক, দুধ পান করবেই। সেজন্যেই তো সারা বিশ্বের মধ্যে সব থেক লম্বা হল ডাচেরা। এবং বিজ্ঞানিরাও বারবার একথা মেনে নিয়েছেন যে বিশ্বের এই অংশের মানুষদের এমন লম্বা হওয়ার পিছেন দুধ ছাড়া আর কিছুর ভূমিকা নেই।
সুতরাং, লম্বা হতে চাইলে দুধ পান করতেই হবে। কেননা, দুধ ও যেকোন দুগ্ধজাত খাবার গুলিতে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন এ, বি, ডি ও ই এর মতো অপরিহার্য খনিজ গুলির পরিমাণ থাকে বেশ উচ্চ। যা মানব দেহে কোষ বৃদ্ধিতে দারুণ সহায়ক।
৪. Niacin Supplementation
Niacin হল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক পুষ্টি উপাদান, যা ভিটামিন B3 নামেই বেশি পরিচিত। একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, দৈনিক ৫০০ গ্রাম নিয়াসিন সেবনকারী মানুষের থেকে সাধারণ মানুষের দৈহিক বৃদ্ধি তুলনামূলক ভাবে কম ঘটে। কাজেই লম্বা হওয়ার উপায় হিসেবে নিয়াসিন সেবন দারুণ কার্যকরী।
৫. মানসিক চাপ কমানো
দৈহিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি বড় বাঁধা হল, স্ট্রেস বা মানসিক চাপ। অতিরিক্ত মানসিক চাপে দেহে হরমোনের মাত্রা কমে যায় এবং করটিসল উৎপাদিত হয়। তবে ভিটামিন C সম্পূরকসমূহ এই করটিসল কমাতে জোর সহায়তা করে। সুতরাং করটিসলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং দৈহিক বৃদ্ধিকে আরো ত্বরান্বিত করতে মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়।
৬. পর্যাপ্ত ঘুম
লম্বা হওয়ার সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকরী উপায় হল পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম। সঠিক এবং সুন্দর ভাবে ঘুমানো আপনার দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধির মাত্রা আরও বাড়িয়ে তোলে। কারণ, পর্যাপ্ত ঘুমালে শরীর লম্বা হওয়ার মতো যথেষ্ট সময় পায়। আপনার বয়স যদি ২০ এর কম হয় তাহলে কমপক্ষে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমান । কেননা, শরীর বৃদ্ধিকারী গ্রোথ হরমোনটি গভীর ঘুমের সময়ই উৎপন্ন হয়।
৭. দৈহিক বৃদ্ধিতে সুষম খাদ্য গ্রহণ
লম্বা হওয়ার উপায় হিসেবে সুষম খাদ্য গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সঠিক খাবার না খেলে বা শরীর অপুষ্টির শিকার হলে সঠিক বৃদ্ধি সম্ভব নয়। আসুন, জেনে নিই এমন কিছু সুষম খাবারের নাম, খাদ্য তালিকায় যারা স্থান পেলে শরীর সুস্থ্য থাকার পাশাপাশি বাড়বে দেহের উচ্চতাও-
ডিম: উচ্চতা বাড়াতে সবচেয়ে কার্যকর ও জনপ্রিয় একটি সুষম খাদ্য হল ডিম । এতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম, রিবোফ্ল্যাবিনসহ বিভিন্ন ধরণনের প্রোটিন ও ভিটামিন রয়েছে, যা দৈহিক বৃদ্ধির জন্য আবশ্যক। এছাড়াও, ডিমে থাকা উচ্চমাত্রার প্রোটিন উপাদান হাড়ের উন্নয়ন ও হাড়কে শক্তিশালীকরণে কাজ করে।
ডার্ক চকোলেট: ডার্ক চকোলেট খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি দৈহিক বৃদ্ধিতেও দারুণ সহায়ক। এতে থাকা ক্যালরি দৈহিক কোষ বৃদ্ধি করে দেহের উচ্চতা বাড়াতে সাহায্য করে।
তালের গুড় ও দুধের মিশ্রণ: খালি পেটে এই মিশ্রণটি খেলে দুর্দান্ত ফল পাওয়া যায়। কারণ, দুধের সঙ্গে তালের গুড় মিশিয়ে খালি পেটে খেলে দুধের কার্যকারিতা আরো দশগুন বেড়ে যায়। আর এই মিশ্রণটি খেলে আমাদের দেহ খাদ্যের সবগুলো পুষ্টি উপাদান খুব সহজেই শুষে নিতে পারে ।
বাদাম: বাদাম হল উচ্চ পুষ্টিগুনে সমৃদ্ধ একটি সুষম খাদ্য যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাদামে থাকা বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন ও ভিটামিন দেহে পূর্ণ পুষ্টি যোগায় ও লম্বা হতে সাহায্য করে। বাদামে উপস্থিত ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যামাইনো এসিড, দেহের টিস্যু মেরামত এবং নতুন হাড় ও মাংসপেশির বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ফলে উচ্চতাও বাড়ে।
মটরশুঁটি: মটরশুঁটি ছোট বড় সবারই বেশ পছন্দের। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ফাইবার, মিনারেল, লুটেইন ও প্রোটিন আছে যা শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং উচ্চতা বাড়াতেও দারুণ সহায়ক।
শীম: শীম এক্টি উদ্ভিজ আমিষ। শীমের বীজে প্রচুর ভিটামিন এবং প্রোটিন রয়েছে যা দেহের উচ্চতা বৃদ্ধিতে প্রধান ভুমিকা পালন করে। এতে থাকা খনিজ উপাদান টিস্যু এবং মাংসপেশি গঠনে সহায়তা করে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই দেহের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়।
সবুজ শাক-সবজি: সবুজ পাতাবহুল শাক-সবজিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ পুষ্টি এবং খাদ্য আঁশ থাকে যা স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যেমন সহায়ক তেমনি দেহের গ্রোথ হরমোন নিঃসরণে উদ্দীপনাও যোগাতেও দারুণ কার্যকারী।
লম্বা হতে চাইলে করণীয় যে বিষয়গুলো সচেতনভাবে মেনে চলতে হবে
এটা সত্যি যে উচ্চতা বৃদ্ধিতে জেনেটিক ফ্যাক্টর শতকরা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভুমিকা পালন করে। তবে আপনার কিছু সচেতনতা পারে আপনার উচ্চতা বয়সের সঙ্গে সমান তালে বৃদ্ধি করতে।
চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক, লম্বা হতে চাইলে যে সচেতনতা গুলো মেনে চলতে হবে-
ভাজ হয়ে বসা এড়াতে হবে: চেয়ারে বসার সময় আপনার পা অবশ্যই ৯০ ডিগ্রি এঙ্গেলে রেখে সোজা হয়ে বসুন, ভাঁজ হয়ে বসা এড়িয়ে চলুন। কেননা, সবসময় ভাঁজ হয়ে বসে থাকলে আপনার শিরদাঁড়া অস্বাভাবিক আকার ধারণ করবে, যা আপনাকে আপনার থেকে খাঁটো দেখাতে যথেষ্ট।
শিরদাঁড়ার মাংশপেশি সংকুচিত হতে থাকলে আপনি এক সময় যেকোন বড় ধরনের রোগেও আক্রান্ত হতে পারেন। তাই আপনাকে যদি দীর্ঘ সময়ের জন্য বসে কোনো কাজ করতে হয়, তাহলে কাজের ফাঁকে সামান্য বিরতি দিয়ে প্রতি ৩০ মিনিট পর পর উঠে হাঁটাচলা করুন।
ঘুমের সময় কিছু সচেতনতা: ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ সময় আমরা ঘুমের জন্য ব্যয় করি। ফলে ঘুমের সময় মেরুদণ্ড একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সংকুচিত অবস্থায় থাকে। যা বাড়ন্ত বয়সে উচ্চতা বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
তাই ঘুমোবার সময় অবশ্যই আরামদায়ক বিছানার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে মেরুদণ্ড সোজা থাকে এবং আপনার বৃদ্ধিতে কোন বাঁধার সৃষ্টি না হয়।
শেষ কথা
একটি গবেষণায় দেখা গেছে দেহের বৃদ্ধিতে প্রায় ২০% প্রভাব বিস্তার করে আমাদের খাদ্যাভ্যাস, পরিবেশ ও আমাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ। সুতরাং আজকের আর্টিকেলের আলোচ্য উপায় সমূহ আমলে নিয়ে, এই বিষয় গুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেই আমরা বাড়াতে পারবো আমাদের দেহের উচ্চতা, লম্বা হতে পারবো আরো একটু বেশি।
প্রয়োজন মনে হলে পড়ে দেখতে পারেন-