মোবাইল শব্দটির সাথে পরিচিত নেই এমন মানুষ বর্তমান দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৮৭% মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। নিত্যদিনের নানান প্রয়োজনে মোবাইল ফোনের গুরুত্ব অপরিসীম। এই যে একটি যন্ত্র যা ছাড়া আমরা এক মুহূর্তও চলতে পারিনা, তা সম্পর্কে আমরা সবাই কতটুকুই বা জানি। চলুন জেনে নেওয়া যাক মোবাইল ফোন সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা হয়তো আমরা অনেকেই জানিনা।
মোবাইল অর্থ স্থানান্তরযোগ্য বা ভ্রাম্যমাণ। এই ফোনের নাম মোবাইল হওয়ার কারণ হলোঃ এটি যেকোনো জায়গায় সহজেই স্থানান্তর অর্থাৎ বহন ও ব্যবহারযোগ্য। ষড়ভুজাকৃতির সেল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মোবাইল ফোন কাজ করে থাকে। বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করা হয় বলে বিশাল আয়তনের ভৌগোলিক এলাকাতেও এই যন্ত্রটির মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ সম্ভব হয়।
মোবাইলে ব্যবহৃত নেটওয়ার্ককে সেলুলার নেটওয়ার্ক বলা হয়। আর এই নেটওয়ার্কগুলো বিভিন্ন সেলে বিভক্ত হয়ে কাজ করে। ফলে, এই ফোনকে সেলুলার ফোন বা সংক্ষেপে সেলফোন ও বলা হয়। ইংরেজি ‘Mobile Phone’ এর আক্ষরিক অনুবাদ মুঠোফোন না হলেও এটিই এখন প্রচলিত।
হাতের মাধ্যমে ব্যবহার ও বহন করা যায় বলে একে মুঠোফোন নাম দেওয়া হয়েছে। কবি নির্মলেন্দু গুণ তার একটি কবিতায় প্রথম এই ‘মুঠোফোন’ নামটি ব্যবহার করেন।
মোটোরোলা ডায়না টিএসি ৮০০০ এক্স (DynaTaC 8000x) হলো বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক সংস্করণের ফোন যা বাজারে আসে ১৯৮৩ সালে। এরপর ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল অর্থাৎ মাত্র ২১ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ বিলিয়ন যা পূর্বে ছিলো মাত্র ১২.৪ মিলিয়ন।
তবে বিশ্বের প্রথম মোবাইল ফোন আবিষ্কৃত হয় ১৯৭৩ সালে আমেরিকার নিউইয়র্কে। যার ওজন ছিলো প্রায় ২ কেজি (৪.৪ পাউন্ড)। এটির আবিষ্কারক হিসেবে মর্যাদা পান ডাঃ মার্টিন কুপার ও জন ফ্রান্সিস মিচেল। যারা দুজনেই মোটোরোলা কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। তারাই প্রথম হাতে ধরা এই ফোনের মাধ্যমে কল করতে সক্ষম হন।
যে ফোনগুলোর মাধ্যমে প্রাথমিক টেলিফোন যোগাযোগ সম্পন্ন হয় তাকে প্রায়ই ফিচার ফোন বলা হয়। এগুলোকে নিম্নস্তরের মোবাইল হিসেবে ধরা হয়। আর স্মার্টফোন হিসেবে খ্যাত ফোনগুলোর সুবিধা আরো অগ্রসর এবং এগুলো কম্পিউটারের মতো সেবা প্রদান করে থাকে।
বিশ্বে এই স্মার্টফোন অধ্যায়ের সূচনা হয় ১৯৯৮ সালে। আইবিএম এবং মিতসুবিসি ইলেকট্রিক কর্পোরেশন তাদের যৌথ উদ্যোগে বিশ্বের প্রথম স্মার্টফোন তৈরি করেন। তারা ফোনটির নাম দেন সিমন।
কিছু নির্দিষ্ট ব্যবহারকারীকে উদ্দেশ্য করেই বেশ অনেক মোবাইল ফোনের পরম্পরা তৈরি করা হয়েছে। এমন একটি ফোন হলোঃ ব্ল্যাকবেরী। যা বহুজাতিক বা কর্পোরেট ব্যবহারকারীদের জন্য বিশেষ ই-মেইল সুবিধা নিয়ে এসেছে।
‘ওয়াকম্যান’ সিরিজ হলো সনি-এরিক্সনের একটি ফোন। যা গান শোনার জন্য বিশেষায়িত। এছাড়াও রয়েছে নকিয়ার এন সিরিজ মাল্টিমিডিয়া ফোন, আইফোন সিরিজ বা স্যামসাং এর গ্যালাক্সি সিরিজ এবং ক্যামেরাফোন হিসেবে সাইবারশট।
মোবাইল ফোন সিস্টেমের বিভিন্ন প্রজন্ম
১৯৪০ সালের দিকে সর্বপ্রথম যুক্তরাষ্ট্রে মোবাইল ফোন সার্ভিস চালু হয়। পরবর্তীতে ১৯৫০ সালের শুরুতে ইউরোপের মোবাইল সার্ভিস চালু হয়। মোবাইল ফোনের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার ও উন্নয়নের এক একটি ধাপকে মোবাইল ফোনের প্রজন্ম বলে। মোবাইল ফোনের প্রজন্মকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা –
১। প্রথম প্রজন্মঃ
প্রথম প্রজন্মের মোবাইল ফোন গুলো ছিলো সেলুলার নেটওয়ার্ক নির্ভর এবং এনালগ সিস্টেমের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে সর্বপ্রথম সেনাবাহিনীর বাহিরে নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনের ব্যবহার শুরু হয়।
তবে বাণিজ্যিকভাবে ১৯৭৯ সালে মানুষের মধ্যে মোবাইল ফোনের ব্যবহার শুরু হয় যাকে প্রথম প্রজন্মের মোবাইল ফোনের সূচনাকাল বলা হয়।
১৯৮১সালে NMT কর্তৃক আন্তর্জাতিক রোমিং সুবিধা সহ প্রথম প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক এর দ্বিতীয় যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে উত্তর আমেরিকায় বাণিজ্যিকভাবে প্রথম প্রজন্ম মোবাইল চালু করা হয় যার নাম ছিল AMPS।
প্রথম প্রজন্মের মোবাইল ফোনের বৈশিষ্ট্যগুলো হলো – নেটওয়ার্কে রেডিও সিগন্যাল হিসেবে অ্যানালগ সিস্টেম এর ব্যবহার, নেটওয়ার্কে স্ট্যান্ডার্ড, চ্যানেল অ্যাক্সেস পদ্ধতি, মোবাইল ফোনসহ আকারে ছোট এবং ওজনে হালকা, সিগন্যাল ফ্রিকুয়েন্সি তুলনামূলকভাবে কম, মাইক্রোপ্রসেসর এবং সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি। AMPS, NMT, TACS ইত্যাদি এর উদাহরণ।
২। দ্বিতীয় প্রজন্মঃ
প্রথম প্রজন্মের অ্যানালগ সিস্টেমের মোবাইল ফোনের পরিবর্তে দ্বিতীয় প্রজন্মের ডিজিটাল মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু হয়। ১৯৯০ সালে ইউরোপের দ্বিতীয় প্রজন্মের মোবাইল ফোন সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয়।
ট্রান্সমিশন কোয়ালিটি, সিস্টেম ক্যাপাসিটি এবং বিশাল এলাকাজুড়ে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে দ্বিতীয় প্রজন্মের সিস্টেম চালু করা হয়। ভয়েসকে মুক্ত করার মাধ্যমে দ্বিতীয় প্রজন্ম মোবাইল ফোনের আবির্ভাব ঘটে।
১৯৯১ সালে ফিনল্যান্ডের সর্বপ্রথম GSM নেটওয়ার্ক Radiolinja চালু হয়। ১৯৯২ সালে যুক্তরাজ্যে মেশিন নিয়ন্ত্রিত এবং ১৯৯৩ সালে ফিনল্যান্ডে Person to Person SMS টেক্সট মেসেজ সার্ভিস চালু হয়। ফিনল্যান্ডে ২০০০ সালে সর্বপ্রথম মোবাইল ফোন ব্যবহার করে দৈনিক নিউজ হেডলাইন বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়।
দ্বিতীয় প্রজন্মের মোবাইল ফোনের বৈশিষ্ট্য
ডিজিটাল পদ্ধতির রেডিও সিগন্যাল, চ্যানেল এক্সেস পদ্ধতি, TDMA, FDMA, CDMA, সীমিত মাত্রায় আন্তর্জাতিক রোমিং সুবিধা, GSM পদ্ধতিতে ডাটা এবং ভয়েস প্রেরণ করা সম্ভব, ডেটা স্থানান্তর করার গতি অনেক বেশি।
সর্বপ্রথম প্রিপেইড পদ্ধতি চালু হয়- MMS ও SMS সার্ভিস চালু হয় ইত্যাদি। GMS-900, GMS-R, GSM-1800, GSM-400, Digital AMPS, CDMA ইত্যাদি এর উদাহরণ।
৩। তৃতীয় প্রজন্মঃ
দ্বিতীয় প্রজন্ম থেকে তৃতীয় প্রজন্মের প্রথম প্রযুক্তিগত পার্থক্য হচ্ছে সার্কিট সুইচিং ডেটা ট্রান্সমিশন এর পরিবর্তে তৃতীয় প্রজন্মের প্যাকেট সুইচিং ডেটা ট্রান্সমিশন এর ব্যবহার।
২০০১ সালের মে মাসে জাপানের টোকিও এলাকায় NTT ডোকোমো চালু করে প্রথম অ-বাণিজ্যিক ও পরীক্ষামূলক থ্রিজি নেটওয়ার্ক। এ প্রজন্মেই আধুনিক মোবাইল টেকনোলজি HSPA এর বাস্তবায়ন করা হয়।
তৃতীয় প্রজন্মের উচ্চগতির ট্রান্সফার ও মাল্টিমিডিয়া ডাটা ব্যবহারসহ CDMA ও GPRS স্ট্যান্ডার্ডের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। ফলে সর্বাধিক ডেটা ট্রান্সফারের মোবাইল টেকনোলজি EDGE চালু হয়।
২০০৭ সালে তৃতীয় প্রজন্মের নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৯৫ মিলিয়নে দাঁড়ায়। যা ছিল মোট মোবাইল ব্যবহারকারীর মাত্র ৯%।
তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল ফোনের বৈশিষ্ট্যগুলো
প্যাকেট সুইচিং ও সার্কিট সুইচিং উভয় পদ্ধতিতে ডেটা ট্রান্সমিশন। মডেম সংযোজনের মাধ্যমে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট এর ব্যবহার। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি W-CDMA এবং UMTS স্ট্যান্ডার্ড, অধিক পরিমাণ ডেটা স্থানান্তর, ডেটার রেট এমবিপিএস এর অধিক, আন্তর্জাতিক রোমিং সুবিধা ইত্যাদি।
সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট সংযোগ, ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভয়েস এবং ডেটা স্থানান্তর, যেকোনো সময় ইন্টারনেট ব্রাউজ করা, ইন্টারনেট গেম খেলা, ভিডিও কনফারেন্স, গান শোনা, টিভি ও সিনেমা দেখা, চাহিদা অনুযায়ী ডাউনলোড করা ইত্যাদি তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল ফোনের সুবিধাগুলোর মধ্যে অন্যতম। UMTS, IMT-2000, MC-CDMA, TD-SCDMA, EDGE, HSPA ইত্যাদি প্রযুক্তি এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
৪। চতুর্থ প্রজন্মঃ
বর্তমান সময়ের জনপ্রিয়তম মোবাইল ফোন সিস্টেম হলো চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ফোন। এ প্রজন্মের মোবাইল সিস্টেম এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সার্কিট সুইচিং বা প্যাকেট সুইচিং এর পরিবর্তে ইন্টারনেট প্রটোকল (IP) ভিত্তিক নেটওয়ার্কের ব্যবহার। IP ব্যবহারের ফলে মোবাইল টেলিফোন সিস্টেম ভিত্তিক নেটওয়ার্ক ব্যবহারের মাধ্যমে ডাটা আদান-প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে।
চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল ফোন সিস্টেম এ আল্ট্রা-ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করা সম্ভব। চতুর্থ প্রজন্মের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মধ্যে WiMAX, FLASH-OFDM, 3GPP LTE ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১০ সালের শুরুর দিকে ওয়ারলেস ইন্টারনেট সুবিধাসহ ই-রিডার বাজারে আসে।
সর্বশেষ ওয়ারলেস ইন্টারনেট সুবিধা সহ অ্যাপেল কোম্পানির iPAD নামক ট্যাবলেট ডিভাইস বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল ফোনের বৈশিষ্ট্যসমূহ
উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্যাকেট ডেটা ট্রান্সমিশন। উচ্চগতিসম্পন্ন ওয়ারলেস ব্রডব্যান্ড সার্ভিস ও ফ্রিকোয়েন্সি। পোর্টের মাধ্যমে সরাসরি কম্পিউটারে ব্যবহার করা যায়। ত্রিমাত্রিক ছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা, ইত্যাদি।
মোবাইল ফোনের জনক মার্টিন কুপারের তৈরি মোবাইলটি ছিলো আজকের মোবাইল ফোনের তুলনায় বিরাট আকারের। অনেকে এর নাম দিয়েছিলেন শু। এটার আকৃতিই ছিলো অনেকটা জুতার মতো। ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কুপার এর আরেকটা নাম দিয়েছিলেনঃ ডাইনামিক অ্যাডাপটিভ টোটাল এরিয়া কাভারেজ। সংক্ষেপে ডাইনাট্যাক।
তার স্বপ্ন ছিলো এমন একটি ফোন তৈরি করার যা দিয়ে মানুষ যখন যেখানে ইচ্ছা অবাধে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। তার সেই স্বপ্নের পথ ধরেই এতোদূর এগিয়ে এসেছে এই মোবাইল ফোন।
পড়ার মতো আছে আরও কিছু-