“আমি বাংলায় গান গাই, আমি আমার আমিকে যেনো বাংলায় ফিরে পাই”। এত সুন্দর গানটির মত আমরা কথা বলি বাংলাতে। গান গাই বাংলাতে। এবং লেখালেখিও বাংলাতেই বেশির ভাগ করে থাকি। কারণ বাংলাই আমাদের মাতৃভাষা। জন্মের পর মায়ের মুখে আমরা এই ভাষাই প্রথমে শুনি। এই ভাষায় জন্য কত লড়াই হয়েছে, তা আমাদের মনে রেখেই ভালোবাসতে হবে এই বাংলা ভাষাকে।
চলছে ভাষার মাস। আমরা বাঙালি, বাংলা ভাষা আমাদের অহংকার। এ ভাষার জন্য বায়ান্নতে প্রাণ দিয়েছেন- শফিক, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকে। নিজেদের ভাষা রক্ষার জন্য প্রাণ দেওয়া, বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়ার কারণে আমাদের দেশে কথ্য ও লেখ্য ভাষা হিসেবে শতকরা প্রায় ৯৫ জনই বাংলা ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু ইদানিং ভাষার ব্যবহারে সবাই হয়ে উঠছে অসতর্ক। ভাষায় লক্ষ করা যায় গুরুচন্ডালী দোষ।
বাংলা ভাষা বাংলাদেশের নদীগুলোর মতোই দূষিত হয়ে উঠেছে। এই দূষণ হবার কারণও রয়েছে তিনটি—
১. ইংরেজি বা আঞ্চলিক ঢঙে প্রমিত বাংলা উচ্চারণ।
২. কথা বলার সময় বাংলা শব্দের পরিবর্তে ইংরেজি-হিন্দি-আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার।
৩. বানান বিকৃতি।
বিশেষ করে গণ্যমাধ্যমগুলোতে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যারা বাংলা ভাষার ব্যবহার করছে, বেশিরভাগই ইংরেজি ঢঙে বাংলা বলে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। এফএম রেডিও গুলোতে এখন এভাবেই কথা বলা লক্ষ্য করা যায়।
বাংলা ইংরেজির একটা সংমিশ্রণ তৈরি হচ্ছে, যেটা হয়ে যাচ্ছে বাংলিশ এর মত। বাংলা ভাষাকে সবচেয়ে বেশি ঝামা ঘষা হতে হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে।
বাংলা ভাষার বয়স প্রায় চৌদ্দশত বছর। কালের বিবর্তনে আরও বিভিন্ন ভাষায় সমাহার এসে এতে যুক্ত হয়েছে। এই ভাষাতে আবার সংস্কৃত,তৎসম ও তদ্ভব শব্দের ব্যবহারও রয়েছে। আবার আমরা বাঙালিরা নিজ নিজ আঞ্চলিক ভাষায়ও কথা বলি।
অনেক সময় যারা লোকসমাবেশে শুদ্ধ ভাষা বলেন, তাদের সামনে আঞ্চলিক ভাষা বলতে দ্বিধাও বোধ করি। এই দিক থেকে দ্বিধা বোধের কিছু নেই বলেই আমি মনে করি।
বাংলাদেশের নাটক সিনেমার পর্দাগুলোতে বেশ সুন্দর ভাবেই ফুটিয়ে তুলছে নিজেদের আঞ্চলিকতাকে। কিন্তু আমরা যখন কিছু লিখতে যাবো, তখন অবশ্যই সর্বদিক থেকে শুদ্ধতার প্রয়োগ ঘটা উচিত বাংলা ভাষায়।
লক্ষ্য করলে দেখবেন, সামাজিক মাধ্যমে যাদের সাথে কথা হচ্ছে তারা বাংলা ইংরেজিটাকে একদম এক করে দিয়েছে। “আই মিন দ্যাট আসলে এইটা” এই বাক্যটায় বাংলা ভাষার প্রতি বিকৃতি নজরে পরার মত। আবার ইদানিং খাইছি, গেছিকেও শুদ্ধ বাংলার সাথে যুক্ত করে দিচ্ছে বর্তমান সমাজ। আবার ফেসবুকে ব্যবহৃত কিছু শব্দ মাঞ্জা মারা, পল্টিবাজ, হুদাই প্যাচাল, তেলবাজ, চালবাজ, তারছিড়া, কুফালাগা, গুষ্ঠি কিলাই, বেইল নাই, যাইগা বাদ দে, আরে মামু, প্যাচগি মারে, সুইসাইড খামু, ঠ্যাক দিছে আল্টামডার্ণ, কইছে তরে, কঠিন চেহারা, মাইনকাচিপা ইত্যাদি।
এগুলো সাধারণত কোনো আঞ্চলিক ভাষাও নয়। এটাও এক প্রকার ভাষার বিকৃতি। মজার ছলে বন্ধু বান্ধবকে ছোট করেও আমরা ব্যবহার করছি অশ্লীল শব্দ। যা ভাষাকে আরও কলুষিত করছে।
বাংলা ভাষাকে এভাবে ব্যবহার করতে থাকলে তবে এই ভাষা মিশে যাবে অন্য ভাষার সাথে। ভাষার শিকরকে শক্ত রাখার দায়িত্ব ভাষাবীদদের। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের এই বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে শিক্ষকদের।
সাধারণ জনগণের ভাষা নির্ধারণে তেমন গুরুত্ব বহন করে না। লেখক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, শিল্পীরা হচ্ছে বিশেষ মানুষ। উনাদের কারো ভুল বাংলা ব্যবহার আমাদের সেদিকেই ধাবিত করবে।
বাংলা বানান গুলোতে পরিবর্তন হয়েছে, এবং আরও হবে। ফরাসি দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, ভাষা ব্যবহার করতে গিয়ে কানকে কখনো খাটো কর না। যদি এমন হয়, নির্দিষ্ট শব্দটির প্রতি ব্যাকরণের সমর্থন নেই, কিন্তু কান সায় দিচ্ছে, তাহলে ব্যাকরণকে উপেক্ষা করে কানের দাবিকেই মেনে নাও।
প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাও উল্লেখ করা যায়। ব্যাকরণ অনুসারে ‘ইতিমধ্যে’ অশুদ্ধ হলেও প্রচলিত, শুদ্ধ শব্দ ‘ইতোমধ্যে’। কিন্তু বিকৃতিটা তখনই বেশি ঘটে যখন বাংরেজি বলে ফেলছি; এটা যেন আর না হয়। এদিকে একটু বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া উচিৎ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা ভাষা ব্যবহারে সকলকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে বাংলা শব্দের বানান ও উচ্চারণ সর্ম্পকে আরো সতর্ক হওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
“প্রধনমন্ত্রী বলেন, ‘ইদানিং বাংলা বলতে গিয়ে ইংরেজি বলার একটা বিচিত্র প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জানি না, অনেক ছেলে-মেয়ের মাঝে এখন এটা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে গেছে। এভাবে কথা না বললে যেন তাদের মর্যাদাই থাকে না- এমন একটা ভাব।’ তিনি বলেন, ‘এই জায়গা থেকে আমাদের ছেলে-মেয়েদের বেরিয়ে আসতে হবে। যখন যেটা বলবে সঠিকভাবেই উচ্চারণ করবে এবং বলবে।’
শেখ হাসিনা আজ ২রা ফেব্রুয়ারী ২০২১, রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত পাঁচ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী ভাষণে এ কথা বলেন।”
দেশের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অশুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার লেখকের হীনমন্যতাকে বহন করে। একজন বাঙালি হিসেবে শুদ্ধ বাংলা চর্চা করা আমাদের কর্তব্য। বাংলা ভাষা অর্জনের যে রক্তঝড়া সংগ্রাম করতে হয়েছে, পৃথিবীর কোথাও এমনটা হয় নি।
এই ভাষাই আবার পৃথিবীতে চতুর্থ স্থান দখল করেছে। এটাও গর্বের বিষয়। বাংলা ভাষার শুদ্ধতা না শিখেই ইংরেজি মিলিয়ে বাংলিশ ভাষায় অভ্যস্ত হচ্ছি। এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। বন্ধ করতে হবে এগুলো।
শুদ্ধ বানান চর্চার ক্ষেত্রে আরও সচেতন হতে হবে। রাষ্ট্রীয় ভাবেও সেই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
প্রয়োজন মনে হলে পড়ে নিতে পারেন-