মানুষ জীবনে কি চায়? এটি জটিল প্রশ্ন। ব্যাক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা মানুষের। তবে মানুষটি যদি একজন ওয়েব-মাস্টার হন, তাহলে প্রশ্নটি আর তেমন জটিল নয়। একজন আপাদমস্তক ওয়েব-মাস্টার যিনি, তিনি একটি জিনিসই চান – তার ওয়েবসাইটটি গুগলের প্রথম পাতায় স্থান করে নিক।
আর গুগলের প্রথম পাতায় কোনকিছুকে নিয়ে আসা খুব সম্ভবতঃ আধুনিক যুগের অন্যতম চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। আপনি যে পণ্য, যে আইডিয়ার কথাই ভাবুন না কেন, সম্ভাবনা প্রবল যে আপনার পূর্বে না হলেও, অন্তত আপনার সমসাময়িক আরও দশজন সেটি ভাবছেন, বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন – এবং তারাও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন গুগলের প্রথম পাতায় নিজেদের উপস্থিতি তৈরী করার।
গুগলের প্রথম পাতার মাহাত্মটি কি? আসলে এটি বলাটাও বাহুল্য। যারাই অনলাইনে কিছু একটা করার প্রচেষ্টা নিয়েছেন জীবনে একবার হলেও, তারাও জানেন এর উত্তর। তারপরও বলছি। আসলে গুগলের প্রথম পাতা বাদে, অন্য পাতাগুলোর তেমন কোন মাহাত্মই নেই।
একটি অত্যান্ত প্রচলিত উক্তি রয়েছে এই বিষয়ে – “ধরুন আপনি কাউকে খুন-টুন করে ফেললেন, একদম ঘাবড়াবেন না, ডেডবডিটি গুগলের দ্বীতিয় পাতায় লুকিয়ে ফেলুন, কস্মিনকালেও কেউ হদিস পাবে না।”
আসলেও তাই। গুগলে কোন কিছু সার্চ করলে আপনি কি প্রথম পাতার পরে আর যান? বা যাওয়ার প্রয়োজন কি হয়? সুতরাং আপনার ওয়েবসাইটও গুগলের প্রথম পাতায় না থাকলে মানুষের চোখে সেটি কোনদিন পড়বে, এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। অনলাইন জগতে আরও একটি বেওয়ারিশ লাশে পরিণত হবে আপনার সাইট।
আরও পড়ুন-
পুরনো সাইটগুলোর জন্যই গুগলের প্রথম পাতায় আসা কঠিন কর্ম। সেখানে আপনার সাইট যদি নবজাতক পর্যায়ে থাকে, তাহলে গুগল তাকে গণ্যই করবে না। একটি নতুন ওয়েবসাইট আপনি লঞ্চ করার পর, কমপক্ষে দুই সপ্তাহ কি আরও বেশী সময় লেগে যায় গুগলের তাকে গ্রাহ্য করতেই।
গুগল আপনার সাইটের খবর পেয়েছে কি না, সেটি জানার অব্যর্থ উপায় হচ্ছে গুগুলের সার্চ বক্সে গিয়ে লিখুন- site : আপনার ওয়েবসাইটের পূর্ণ ঠিকানা। যেমন, site: yourwebsite.com।
ওয়েবসাইট চালুর প্রথম সপ্তাহে এটি করে দেখুন। দেখবেন, গুগল বলছে “ আপনার অনুসন্ধানটির কোন ফলাফল পাওয়া যায় নি” (বা এরকম যা বলে থাকে গুগল)। অর্থাৎ, তখনও আপনার ওয়েবসাইটের খবর গুগল পায়নি। দুই সপ্তাহ পর একই কাজ আবার করুন। এবার দেখবেন সাইট দেখাচ্ছে গুগলে।
কিন্তু ওটা সবেমাত্র সূচনা। এখনও গুগলের ওয়েব-ক্রলারগুলি আপনার সাইটের বিভিন্ন পোস্ট, তথ্য এসব কিছুই হালনাগাদ করতে পারেনি। এই বিষয়টি সম্পূর্ণ হতে হতে আরও চার সপ্তাহ কি মাস খানিক লেগে যেতে পারে। এভাবে প্রায় তিন থেকে চার মাস মত লেগে যাবে, শুধু গুগলে আপনার সাইটের উপস্থিতি তৈরী হতেই।
মানুষ গুগলের সার্চ বাক্সে কীওয়ার্ড টাইপ করে আপনার সাইটকে প্রথম পাতায় দেখবে, তাতে ক্লিক করে ভেতরে ঢুকে পোস্ট পড়বে, আর আপনি একজন জনহিতৈষী ব্লগার হিসেবে পরিচিত পাবেন, এডসেন্স থেকে টাকা কামাবেন – এসব তো আরও বহু-বহু দূরবর্তী সব ব্যাপার স্যাপার।
কেন গুগলের প্রথম পাতায় আসা আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে?
আপনার মত অন্য যারা ওয়েবসাইট বানিয়েছেন, পণ্য বিক্রী করতে চাচ্ছেন, তাদের সাথে তো প্রতিযোগিতা আছেই; তা বাদেও, গুগলের আরও বেশ কিছু পক্ষপাতিত্বের কারণে প্রথম পাতায় সবসময়ই সাধারণ ওয়েবমাস্টারদের পিছিয়ে থাকতে হয়।
পিপিসিঃ পিপিসি অর্থাৎ, গুগল এডওয়ার্ডসের পে-পার-ক্লিক বিজ্ঞাপন সমূহ। জনপ্রিয় কীওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করলে সবার প্রথম পাতায় একদম শীর্ষে এবং সর্বনিম্নে এই লিংকগুলো দেখিয়ে থাকে গুগল। এসব সাইটের মালিকরা তাদের অবস্থানটি পাওয়ার জন্য মোটা অংকের টাকা ব্যয় করেছেন।
বিজ্ঞাপনে প্রতিটি ক্লিকের জন্য তারা পাবলিশারদের (বা বিজ্ঞাপনটি যারা দেখায়) সম্মানি দিয়ে থাকেন। লিংকগুলোর নীচেই এডওয়ার্ডের কথাটি সবুজ রঙে উল্লেখ করা থাকে। এই বিজ্ঞাপন গুলোর বদৌলতে, প্রথম পাতার শীর্ষে স্থান পাওয়া দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাড়াচ্ছে দিন দিন।
গুগল লোকাল ম্যাপঃ আপনি যদি ঢাকা শহরে বসে কোন কিছু সার্চ করেন, ধরা যাক সার্চ বাক্সে “বার্গার” লিখলেন, তাহলে আপনার বাড়ির নিকটবর্তী ঢাকার বার্গারের দোকানগুলোকেই দেখাবে গুগল। গুগল সবসময়ই চায় তার ব্যবহারকারীরা সর্বোচ্চ উপকৃত হোক। সুতরাং এমনটা প্রদর্শন করাই অধিক যৌক্তিক। তবে এই একই কারণে ওয়েবমাস্টারদের পরিশ্রম করতে হবে বেশী।
আপনার লেখা একটি ব্লগ, ইন্ডিয়ার একজন গুগল ব্যবহারকারীর প্রথম পাতায় তখনই আসবে, যদি ঐ বিষয়ে আপনার থেকে ভালো ব্লগ পৃথিবীতে আর কেউ না লিখে থাকেন।
ফিচার্ড স্নিপেটঃ গুগলে জনপ্রিয় কিছু সার্চ করলেই দেখবেন, প্রথম পাতার একদম শীর্ষে একটি বক্স দেখাচ্ছে। বক্সের ভেতরে আপনার সার্চকৃত বিষয়ের উত্তরটি প্যারাগ্রাফ বা লিস্ট আকারে দেয়া আছে। নীচে যেই সাইট থেকে এই প্যারাগ্রাফ বা লিস্ট পাওয়া গেল তার লিংক। এই বাক্স বন্দীত্বই গুগলের “ফিচার্ড স্নিপেট”।
অর্থাৎ আপনার সার্চের সবচেয়ে উপযুক্ত উত্তরটি অন্তর্জালের যেখানে রয়েছে বলে গুগলের ধারণা, সেটিকে সে আপনার জন্য বাছাই করে এনে একদম রূপার থালায় করে আপনার সামনে পেশ করেছে।
খেয়াল করবেন যে, এই বাক্সের ভেতরে লেখাটি পাঠ করলেই আপনি আপনার উত্তর পেয়ে যাচ্ছেন। প্রথম পাতার অন্য লিংকগুলো, বা আপনার সার্চের অন্য রেজাল্টগুলোতে দৃ্ষ্টিপাতের প্রয়োজনই পড়ছে না।
এই বিষয়টি গুগলের ব্যাবহারকারী হিসেবে চমৎকার হলেও, একজন ওয়েবমাস্টারের জন্য হতাশাজনক। কারণ এখন বিষয়টি এমন দাড়াল যে, আপনি গুগল ওয়েবসাইটের একদম প্রথম পাতায় স্থান করে নিলেও মানুষের নজরে পড়বেন না।
আপনাকে গুগলের মাধ্যমে “ফিচার্ড” হতে হবে। এবং গুগল সাধারণতঃ তাদের রেংকিংয়ে সেরা দশের মাঝে আসতে পেরেছে, এমন পেজগুলোকেই ফিচার্ড করে। সুতরাং ফিচার্ড স্নিপেট আরও একটি বিষয় যে কারণে গুগলের প্রথম পাতায় স্থান করে নেয়া প্রতিনিয়ত আরও কঠিন হয়ে উঠছে।
পিপল-অলসো-আস্ক বা রিলেটেড কোয়েশ্চেনসঃ একটি গুগল সার্চের কথা কল্পনা করুন। আপনি আপনার জিজ্ঞাসাটি লিখলেন সার্চ বক্সে। এই জিজ্ঞাসাগুলো গুগলের কাছে কী-ওয়ার্ড।
আপনার কী-ওয়ার্ড সাপেক্ষে ফলাফল তো গুগল দেখাবেই, পাশাপাশি আপনার প্রশ্নটির মত আরও যতসব প্রশ্ন অন্য মানুষেরা গুগলকে সাধারণতঃ করে থাকেন সেগুলোও একটি বাছাইকৃত তালিকা রূপে আপনার কাছে হাজির করা হবে। এটিই “রিলেটেড কোয়েশ্চন” বা পিপল-অলসো-আস্ক। অর্থাৎ প্রাসঙ্গিক প্রশ্নসমূহ বা মানুষ আরও যা জানতে চান।
এই প্রশ্ন তালিকায় চোখ বুলালে আপনি দেখবেন, যে জিজ্ঞাসাটি আপনি প্রথমে লিখেছিলেন, তার চেয়েও ভাল বা আপনার আগ্রহ জাগানিয়া প্রশ্ন ঐ তালিকায় রয়েছে। এবং হাতে সময় থাকলে আপনি সেগুলোর কোন একটিতে ক্লিক করবেন।
এই রিলেটেড-কোয়েশ্চনও অনেকটা ফিচার্ড স্নিপেটের মতই। যেসব যোগ্যতা থাকলে, ফিচার্ড-স্নিপেটের বক্সে আপনার সাইট স্থান করে নিতে পারে, রিলেটেড-কোয়েশ্চেনের মারফত আপনার অবধি ব্যবহারকারী বা পাঠককে পৌঁছাতে হলেও, আপনার সাইটটির সেই একই যোগ্যতাগুলো থাকতে হবে।
নতুন ওয়েবমাস্টারদের যারা সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশানের বিষয়গুলো এখনও তেমন ভালো বোঝেন না, তাদের জন্য এটি সমস্যাজনক। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, দীর্ঘ ও অপ্রচলিত কী-ওয়ার্ড ব্যবহার করার কারণে কোন একজন ব্যাবহারকারী হয়তো আরেকটু হলেই আপনার সাইটে চলে আসতেন। কিন্তু গুগল তার সামনে “ পিপল অলসো আস্ক” এর তালিকাটা প্রদর্শন করা মাত্রই তার মনযোগ অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে প্রথম পাতায় উপস্থিতি তৈরীতে এটি আরেকটি প্রতিবন্ধকতা।
গুগল পেইড প্রমোশানঃ পেইড-এডভার্টাইজমেন্ট বা টাকার বিনিময়ে অর্থ-দাতার পণ্যের বিজ্ঞাপন সার্চ রেজাল্টে প্রদর্শন করা গুগলের একটি বিশেষ সেবা। এটি “গুগল এডস” এর মাধ্যমে ঘটতে পারে। আবার গুগলের ‘ডিসপ্লে নেটওয়ার্ক’ এবং গুগলের ‘এডসেন্স প্রোগ্রামের’ মাধ্যমে অন্য ওয়েবসাইটের বিজ্ঞাপনগুলোও হাজির হতে পারে প্রথম পাতায়।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ওয়েবমাস্টারদের শ্রম, মেধা, সৃজনশীলতায় ঘাটতি না থাকলেও, টাকা পয়সা খরচের ব্যাপারটি প্রথম দিকে অনেকের জন্যই সম্ভব হয় না। ওদিকে গুগল একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। সুতরাং, টাকা খরচ করতে পারে এমন লোকদেরই তারা বেশী গুরুত্ব দিবে সে তো জানা কাথাই।
গুগলের পেইড প্রমোশানের এই বিষয়টি সাধারণ ওয়েবমাস্টারদের জন্য প্রতিযোগিতাকে আরও কঠিন করে দিচ্ছে।
গুগলের প্রথম পাতায় জায়গা করে নেওয়াকে এই পাঁচটি বিষয় কঠিন করে তুলছে দিন দিন। তবে এসব শুনে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এটি বাস্তবতা।
যেহেতু মানুষ প্রতিদিনই আরও বেশী ইন্টারনেটমুখী হচ্ছে, ব্যবসা বাণিজ্য সমস্ত কিছুই অনলাইনে চলে আসছে। সুতরাং অন্তর্জালও যে আরও চ্যালেঞ্জ মুখর প্রতিযোগিতা প্রবণ হয়ে উঠবে তাতে আর বিচিত্র কি।
সফল ওয়েবমাস্টার হতে চান এমন প্রত্যেকেরই উপরোক্ত পাঁচটি বিষয় নিয়ে ভালোভাবে পড়াশোনা করা দরকার। তখন হয়তো, প্রতিবন্ধকতার বদলে এই বিষয়গুলো গুগলের প্রথম পাতা দখলের পদ্ধতিতে পরিণত হবে আপনার জন্য।