পৃথিবী যতো আধুনিকায়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, মোবাইল ফোনের উপর মানুষের নির্ভরশীলতা ততো বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কথা নিঃসন্দেহে মানতে হবে যে- মোবাইল ফোন আমাদের জীবনধারাকে অনেক বেশি সহজতর করে দিয়েছে। তবে এই আশির্বাদ ধীরে ধীরে অভিশাপে রূপ নিচ্ছে। আমরা সেটাকেও অগ্রাহ্য করতে পারি না!
বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত কেউই এই আসক্তি থেকে রেহাই পাচ্ছে না। কিভাবে বুঝবেন আপনি মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে গেছেন?
১। যদি আপনার ঠিকঠাক ঘুম না হয়।
২। সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন থাকেন।
৩। অযথা সোশাল সাইটে ঘন্টার পর ঘন্টা ভিডিও দেখেন / স্ক্রল করেন।
৪। সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে বিরক্তিবোধ কাজ করে।
৫। কিছুক্ষন পর পর স্মার্টফোন চেক না করে থাকতে পারেন না।
৬। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ করতে ব্যর্থ হয়ে থাকেন।
৭। যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে সময়ের অভাবে ভোগেন।
৮। সবসময় ডিস্ট্রাক্টেড (বিক্ষিপ্ত) হয়ে যান।
উপরোক্ত লক্ষনগুলো থাকলে ধরে নিতে হবে, স্মার্টফোনে আপনি আসক্ত হয়ে গেছেন।
যেখানে আমরাই ৫ মিনিট পরপর মোবাইল চেক না করে থাকতে পারি না, স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন এসে যায়- “আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অবস্থা কি হবে তাহলে? “।
২০২০ সালে রিভিউস ডট অর্গানাইজেশনের সার্ভে মোতাবেক ৭৫.৪% মোবাইল ব্যবহারকারি মনে করেন তারা মোবাইল ফোনে আসক্ত! এবং, ৬৫.৬% ব্যবহারকারী দিনে ১৬০ বার তাদের মোবাইল ফোন চেক করে থাকেন!
অত্যাধিক মোবাইল ফোন ব্যবহারের কারণে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী হয়ে যাওয়া, প্রাপ্তবয়স্কদের বেকারত্ব, কর্মক্ষেত্রে অমনোযোগী, সাংসারিক সমস্যা ইত্যাদি ছাড়াও চোখে ঝাপসা দেখা, মাথা ব্যথা, ইনসমনিয়া, নমোফোবিয়া, পারকিনসন, ব্রেন টিউমার, ক্যান্সার ইত্যাদির মতো ভয়াবহ অসুখও স্বাস্থ্যের বিচ্যুতি ঘটাতে পারে।
এই ভয়াবহ সমস্যাগুলো থেকে বাঁচতে ও সুন্দর স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করতে মোবাইল ফোন আসক্তি দূর করা অপরিহার্য। আসুন জেনে নেওয়া যাক কিভাবে মোবাইল ফোন আসক্তি দূর করবেন –
০১। প্রতিদিন স্ক্রিন টাইম চেক করুন ও সময়সীমা নির্ধারণ করুন
যখন আপনি কোনো কিছুর সমাধান চাইছেন তখন সবার আগে সমস্যাটি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা রাখা জরুরি। এন্ড্রয়েড ফোন ও আইফোন দুইটিতেই স্ক্রিন টাইম দেখার ফিচার আছে। সেখানে বিস্তারিত দেখতে পারবেন- আপনি কোন অ্যাপে কতক্ষন সময় ব্যয় করছেন, সপ্তাহে কতোটা সময় স্মার্টফোনে ব্যয় হচ্ছে , দৈনিক কমপক্ষে কতো ঘন্টা ব্যয় করছেন।
এক কথায় স্ক্রিন টাইমের পুরো হিস্ট্রি পেয়ে যাবেন এতে । সাধারনত এই ফিচারটি স্ক্রিনের টপে দেখানো হয়। সেখানে না থাকলে সেটিংসে গেলে পাবেন। প্যারা মনে হলে প্লে স্টোরে গেলেই পেয়ে যাবেন।
সাধারণত প্রতিটি এন্ড্রয়েড ফোনেই ডিজিটাল ওয়েলবিং অ্যাপটি থাকে। যার সাহায্য কখন, কিভাবে, কতক্ষন, কোথায় সময় ব্যয় হচ্ছে সব দেখা যায়। যে অ্যাপগুলো মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করেন সেগুলোর জন্য ডিজিটাল ওয়েলবিং অ্যাপটিতে যেয়ে টাইম লিমিট সেট করে দিন। এবং, প্রতিদিন কতক্ষন মোবাইল ফোন ব্যবহার করবেন তার একটা লিমিট সেট করে দিন।
অভিজ্ঞদের মতে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন ২ ঘন্টা মোবাইল ফোন ব্যবহার করা উচিত। ৩/৪ ঘন্টা ব্যবহার করা ঠিকঠাক বা তেমন কোনো সমস্যা নেই। তবে ৪ ঘন্টার উপরে যদি আপনার রেগুলার স্ক্রিন টাইম হয়ে থাকে তাহলে চিন্তার বিষয়।
০২। নোটিফিকেশন বন্ধ করুন ও অপ্রয়োজনীয় অ্যাপস আনইন্সটল করুন
কোনো এক সময় অধির আগ্রহ নিয়ে কোনো কাজ করছি, তারপর নোটিফিকেশনের একটা শব্দ হলো। তৎক্ষনাৎ ভাবলাম ২ মিনিটের জন্য ফোনটা চেক করে আবার কাজ করতে বসবো। তারপর সে ২ মিনিট যে কখন ২ ঘন্টা হয়ে যায় সে খেয়ালটুকুও থাকে না।
এমন আপনার সাথেও হয়, তাই না? এই সমস্যা এড়াতে আজকের পর থেকে যখনই কোনো কাজ করতে যাবেন তখনই গ্রুপ নোটিফিকেশন, অপ্রয়োজনীয় মানুষের অহড়হ ম্যাসেজ, সব মিউট করে কাজ করতে বসবেন।
সবচেয়ে ভালো হয়, সেটিংসে যেয়ে ফ্লোটিং নোটিফিকেশন অফ করে দিলে। এতে করে যেকোনো অ্যাপস আপনার ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারবেন। কোনো নোটিফিকেশন আসবে না স্ক্রিনে।
ফলে সোশ্যাল সাইটে আপনার প্রয়োজন মতো নির্দিষ্ট সময়ে ঢুকে নোটিফিকেশন চেক করবেন। আপনার কাজের সময় অযথা নোটিফিকেশন আপনাকে বিরক্ত করবে না।
আপনার স্মার্টফোনটিতে এমন অনেক অ্যাপস আছে যেগুলো না থাকলেও হয়, কিন্তু আপনি অযথা সেগুলোতে সময় নষ্ট করেন। তাই যতো অপ্রয়োজনীয় অ্যাপস আছে সব আনইন্সটল করে ফেলুন।
দরকারী অ্যাপসগুলো সামনের স্ক্রিনে রাখুন বা একটি ফোল্ডারে রেখে দিন। এতে করে আপনার ফোনটি অনেক বেশি অর্গানাইজ লাগবে। কাজ করার স্পৃহাও বাড়বে।
যদি আপনার ল্যাপটপ বা পিসি থেকে থাকে তাহলে যে অ্যাপসগুলো আপনার সময় নষ্ট করে, সেগুলো ফোন থেকে আনইন্সটল করে দিন। পিসিতে ব্যবহার করুন (যেমনঃ ইউটিউব, ফেইসবুক, ম্যাসেঞ্জার)।
০৩। নিজেকে রুটিনের মধ্যে রাখুন
ঘুম থেকে উঠে মোবাইল ফোন চেক করা বন্ধ করুন। আপনার সারাদিন কতোটা ভালো ও কর্মক্ষম কাটবে তা নির্ধারণ হয়ে যায় ঘুম থেকে উঠার ২-১ ঘন্টার মধ্যেই!
এই সময়টায় যদি সোশ্যাল সাইটে স্ক্রল করে বা অযথা অদরকারী মানুষদের ম্যাসেজ করে এনার্জি নষ্ট করে ফেলেন, তাহলে তার প্রভাব পড়বে বাকি সময়টায়। ঘুম থেকে উঠেই বা ১৫ মিনিটের মধ্যেই যদি স্মার্টফোন চেক করেন তাহলে সারাদিন আপনি লো- ফিল করবেন।
কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যাবে। ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে। সারাদিন অসুখী হওয়ার সম্ভবনা থাকবে।
ইন্টারন্যাশনাল ডেটা কর্পোরেশন এর গবেষণা মতে ৮০% স্মার্টফোন ব্যবহারকারী ঘুম থেকে উঠে স্মার্টফোন চেক করে থাকেন। যা দিনের শুরুতেই তাদের মানসিক প্রশান্তি নষ্ট করে দেয়। এই তালিকায় হয়তো আপনিও আছেন।
নিজেকে কর্মক্ষম রাখতে ও মোবাইল আসক্তি দূর করতে ঘুম থেকে উঠে ১ ঘন্টা মোবাইল ফোন চেক করা থেকে বিরত থাকুন। নিজেকে রুটিনের মধ্যে নিয়ে আসুন।
ঘুম থেকে উঠার পর ১ ঘন্টা ও ঘুমোতে যাওয়ার আগের ১ ঘন্টা যদি মোবাইল ফোন থেকে বিরত থাকতে পারেন তাহলে আপনার মোবাইল ফোন আসক্তি ৪০-৫০% এমনিতেই কমে যাবে!
ঘুম থেকে উঠে সারাদিনের কাজগুলো নোটবুকে লিখে ফেলুন এবং পর্যায়ক্রমে করতে থাকুন। এতে করে আপনার কাজ করার স্পৃহা বাড়বে এবং মোবাইল ফোন থেকে অনেকটাই দূরে থাকা যাবে।
০৪। সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে বের করুন ও আত্মউন্নয়নমূলক কাজে মনোযোগী হন
১। কেন আপনি মোবাইল ফোন আসক্তি থেকে বের হতে চান?
২। মোবাইল ফোন আপনার কি কি ক্ষতি করছে?
৩। এভাবে সময় নষ্ট করলে ভবিষ্যতে আপনাকে কি কি মাসুল দিতে হতে পারে?
মোবাইল ফোন আসক্তি থেকে বের হতে চাইলে, উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর সুনির্দিষ্টভাবে জানা জরুরী। তা-নাহলে প্রথম কিছুদিন মোবাইল থেকে দূরে থাকার আগ্রহ দেখালেও কিছুদিন পর আপনার আগ্রহ শূন্যে মিলিয়ে যাবে।
এরকমটি না চাইলে নিজের মধ্যে ইচ্ছাশক্তি তৈরি করুন এবং একটি নোটবুক ও কলম নিয়ে বসে পরুন। এবার উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর একেক করে লিখে ফেলুন।
প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ৫ মিনিটের জন্য এই লেখাগুলো পড়ুন। এগুলো আপনাকে সারাদিন মোটিভেটেড রাখবে। যে সময়গুলো মোবাইল ফোনে অযথা নষ্ট হতো সে সময়গুলোকে আত্মউন্নয়নমুলক কাজে লাগান।
আপনার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য পূরণে সেসময় গুলোকে কাজে লাগান এবং ভালো কাজ দিয়ে রিপ্লেস করুন। বা নতুন কোনো স্কিল শিখে নিতে পারেন। অথবা বই পড়া, বাগান করা, ছবি আঁকা ইত্যাদি কোনো শখ থাকলে সেগুলোতেও সময় দিতে পারেন। এতে করে আপনার শরীর ও মন উভয় সতেজ থাকবে।
০৫। ডিজিটাল ডিটক্স করুন ও কাছের মানুষদের সাথে বেশি বেশি সময় কাটান
স্মার্টফোন ও বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইস যখন আপনি অত্যাধিক ব্যবহার করেন তখন সেটা আপনার শরীর ও মন উভয়ের উপরই বিরুপ প্রভাব ফেলে। যদিও ডিজিটাল ডিভাইসগুলো আমাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করা উচিত কিন্তু আমরা অধিকাংশ মানুষই প্রয়োজন ছাড়াও ব্যবহার করে থাকি। এবং ঘন্টার পর ঘন্টা অকারণে ব্যবহার করতে করতে কোনো এক সময় এগুলোতে আসক্ত হয়ে যাই।
এসব আসক্তি থেকে বের হওয়ার অন্যতম জনপ্রিয় পদ্ধতি হচ্ছে ডিজিটাল ডিটক্স। ডিজিটাল ডিটক্স বলতে বুঝায়- কোনো একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সকল প্রকার টেক ডিভাইস যেমনঃ- স্মার্টফোন, টেলিভিশন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট ইত্যাদি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা।
এটাকে মূলত চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া হয়। চ্যালেঞ্জটা হয় প্রযুক্তি ও আমাদের ইচ্ছাশক্তির মধ্যে। যদি মনে হয় আপনি স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে গেছেন, ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না, সবসময় উদ্বিগ্ন ও মানসিক চাপে নিমজ্জিত থাকছেন, পড়াশোনা বা অফিসের কাজগুলো ঠিকমতো করতে পারেন না, সময়ের অভাবে ভোগেন কোনো কিছু করতে উৎসাহ পান না বা সোশ্যাল সাইটে মানুষের চাকচিক্য দেখে নিজেকে অনেক বেশি অসন্তুষ্ট মনে হয়, ঠিক তখনই আপনার উচিত ডিজিটাল ডিটক্স করা।
এটি করলে আপনার মানসিক চাপ কমে যাবে। নিজেকে সুখি মনে হবে। ঠিকমতো ঘুম হবে। ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্স করতে পারবেন ও নিজের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব তৈরী হবে।
ডিজিটাল ডিটক্স সাধারণত ১ দিন, ১ সপ্তাহ, ১ মাস পর্যন্ত বা তার কম-বেশি হতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে অতো বেশি সময় না নিলেও হয়। এক্ষেত্রে আপনার সুবিধামতো সপ্তাহে যেকোনো ১ দিন বা ঘুম বাদে ১২ ঘন্টা আপনি ডিজিটাল ডিটক্স বা সকল প্রকার ডিজিটাল ডিভাইস থেকে নিজেকে বিরত রাখুন।
নিজেকে সময় দিন, নিজের পছন্দের কাজ গুলো করার চেষ্টা করুন, নিজের দক্ষতা বাড়াতে প্রত্যয়ী হোন এবং কাছের মানুষদের সাথে বেশি বেশি সময় কাটান। এটা করতে পারলে আপনার আসক্তি ধীরে ধীরে কমে যাবে।
আরও পড়ুন-