হাতের লেখা যার ভালো তার কদর বন্ধু মহল থেকে শুরু করে বড় ভাইয়ের প্রেমপত্র লেখা পর্যন্ত সবখানেই। কেউ যদি আমার কাছে জানতে চায় যে, “কম পড়েও পরীক্ষায় ভালো ফল করার উপায় কি?” তাহলে আমি তাকে হাতের লেখা ভালো করার পরামর্শ দিব।
কেননা স্বাভাবিক ভাবেই একশ খাতার ভেতর যে খাতার প্রশ্নোত্তর সুন্দর হাতের লেখায় লিখা হয়েছে, একজন ভালো শিক্ষক সদা সর্বদাই সেটির দিকেই বিশেষ নজর দিবেন। সবচেয়ে খারাপ হাতের লেখাটি সবচেয়ে সুন্দর হাতের লেখায় পরিনত করা সম্ভব কেবল সময়ের ব্যাবধানে।
সুন্দর হাতের লেখাকে তিন আঙুলের হস্তশিল্পও বলা হয়। এই শিল্প আয়ত্ত করতে তবে আর দেড়ি কেন? চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক হাতের লেখা সুন্দর ও আকর্ষণীয় করার সেরা ১৫ টি উপায়।
(১) প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন
হাতের লেখা সুন্দর করতেই হবে! হাতের লেখা সুন্দর করার ব্যাপারটি দু এক দিন এ করা সম্ভব নয়। যে কারনে লেখা সুন্দর করতে হলে আপনাকে প্রথমেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে আর নিজের ভেতরকার ইচ্ছেশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে হবে, যা আপনাকে লেখা সুন্দর করার এই লড়ায়ে একধাপ এগিয়ে রাখবে।
(২) সুন্দর লেখা সংগ্রহ করুন
এবারে ইচ্ছে অনুযায়ী নিজেকে লেখা সুন্দর করার কাজে নিয়োজিত করুন। এজন্য প্রথমেই একটি সুন্দর হাতের লেখা সংগ্রহ করুন আর সেই লেখাটি অনুসরণ করে প্রতিদিন অনুশীলন করতে থাকুন। আপনার আশেপাশে এমন কেউ যদি থাকে যার হাতের লেখা যথেষ্ট সুন্দর এবং প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য, তাহলে তাকে দিয়ে এক পৃষ্ঠা হাতে লিখিয়ে নিন।
মোটামুটি এক পৃষ্ঠায় বাংলা বর্ণমালার প্রায় সবগুলি অক্ষরই থাকে। আর আশেপাশে এরকম কাউকে না পাওয়া গেলে অন্য কোন উপায়ে লেখা সংগ্রহ করুন।
(৩) লেখার নান্দনিকতা খেয়াল করুন
লেখা তো সংগ্রহ করলেনই, এবার সেই লেখার নান্দনিকতা খেয়াল করার পালা। লেখাটি হাতে নিয়ে প্রথমে একবার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনে মনে পড়ুন আর খেয়াল করুন প্রতিটি অক্ষর। এক্ষেত্রে প্রতিটি অক্ষরকেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সাথে আরো খেয়াল করুন লেখার বিরামচিহ্ন গুলি। কেননা লেখার এবং উচ্চারনের নান্দনিকতা রক্ষায় বিরামচিহ্ন অলঙ্কার স্বরূপ।
(৪) সঠিক উপাদান নির্বাচন করুন
লেখা অনুসশীলন পর্ব শুরুর আগেই সেই উপাদানগুলো নির্বাচন করুন যেগুলো ব্যাবহার করা আপনার জন্য সহজ ও সাবলিল। আপনি যদি মনে করে থাকেন সুন্দর হাতের লেখার জন্য দামি কিংবা বিশেষ কাগজ কলম প্রয়োজন, তাহলে এটি নিতান্তই আপনার ভুল ধারণা। কেননা সুন্দর লেখার জন্য এরকম কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
আপনার উচিত এমন একটি কলম বা পেন্সিল বেঁছে নেয়া যেটি আপনার আঙুলের সাথে সহজে মানিয়ে যাবে। ধরতে সুবিধা হবে এবং লেখার সময় কাগজের উপরেও বেশি জোর দেয়ার প্রয়োজন হবে না। আর শুরুর দিকে লেখার সুবিধার জন্য নোটবুক জাতীয় লাইন টানা কাগজ ব্যাবহার করাই ভালো।
(৫) শুরু করুন অনুশীলন
লেখা সংগ্রহ হল, নান্দনিকতা খেয়াল করা হল, উপকরনও নির্বাচন করা হল, এবারে সত্যিকার অনুশীলন শুরু করার পালা। প্রথম দিকে আস্তে আস্তে খুব সাবধানে লেখা শুরু করুন। লিখতে গিয়ে কোনভাবেই তাড়াহুড়ো করা যাবে না। প্রয়জনে যত
সময় লাগে লাগুক, কিন্তু পুরপুরি ভাবে অনুসরণ করা লেখাটির মতো হুবহু সুন্দর করে লেখার চেষ্টা করুন। শুরুর দিকে লেখা বাঁকা হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই নোটবুক জাতীয় যে লাইন টানা খাতাটি কিনেছিলেন সেটিতেই বার বার অনুশীলন চালিয়ে যান।
(৬) কলম ধরুন সুবিধা মতো
কলম বা পেন্সিল ধরার আসলে কোন নিয়ম নেই। এটা সম্পূর্ণ আপনার হাতের গড়নের উপর নির্ভর করে। তবে চেষ্টা করুন কলম বা পেন্সিল নিব এর কাছাকাছি ধরে লিখার। কিন্তু খুব শক্ত ভাবে ধরে নয়। অনেকের আবার হাত ঘামে যে কারনে কলম বা পেন্সিল ধরতে বেশ অসুবিধে হয়। হাতের কাছে একটি রুমাল অথবা টিস্যু পেপার রাখুন, নির্দিষ্ট সময় পর পর হাত মুছে নিন। এতে কিছুটা হলেও উপকৃত হবেন।
(৭) যতটা সম্ভব সময় নিয়ে লিখুন
ভুলে গেলে চলবে না যে, লেখা কোন দৌড় প্রতিযোগিতা নয়! কাজেই কত দ্রুত লেখা শেষ করবেন এটাকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রতিটি অক্ষর কিভাবে আরো সুন্দর করবেন সেদিকে গুরুত্ব দিন। খুব সূক্ষ্ম ভাবে চেষ্টা করুন অক্ষর গুলোকে তার শ্রেষ্ঠ রূপ দিতে।
(৮) হাত ও কব্জি নমনীয় করুন
লেখা শুরুর আগেই হাত দুটিকে হালকা করে নিন। আর যতটা সম্ভব হাতের কব্জি দুটোকে এদিক ওদিক মুচরে নিন। এতে আপনার লেখার হাত সাবলীল এবং নমনীয় হবে।
অনেক সময় দেখা যায় বেশ কিছু দিন পর লিখতে গেলে হাত খুব একটা চলে না। কারণ লেখার মাঝে বিরতি থাকলে অন্যান্য মাংশপেশির ন্যায় কব্জি বা হাতেও জড়তা চলে আসে।
এই জড়তাকে ঠেকানোর জন্য প্রতিদিন লেখা চর্চা করা যেমন জরুরী তেমনি সকাল বিকাল হাতের ব্যায়ামও কম জরুরী নয়। তবে লেখা শুরু করার আগে যদি পাঁচ-দশ মিনিট হাত ও কব্জির ব্যায়াম করেন তাহলে বেশ লাভবান হবেন।
(৯) বাহু এবং কব্জির অবস্থান ঠিক রাখুন
আপনি হয়তো লেখার সময়য় সুধু আঙ্গুল ব্যাবহার করে থাকেন। কিন্তু হস্তাক্ষরবিদরা আঙ্গুল দিয়ে কলম-পেন্সিল আঁকড়ে ধরেন মাত্র। আর লেখার সময় তারা হাত এবং বাহুকে সমান অবস্থানে রেখে লেখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এটা রপ্ত করার জন্য আপনি আঙ্গুল দিয়ে বাতাসের উপরে কল্পনায় বড় বড় অক্ষর লিখতে পারেন। এতে বাহু এবং কব্জির অবস্থান ঠিক রাখার ব্যাপারটি বেশ সহজ হয়ে যাবে।
(১০) সামঞ্জস্য রক্ষা করে লিখুন
সামঞ্জস্য বজায় রেখে সর্বোত্তম ভাবে লিখতে চাইলে চেয়ার টেবিলের বিকল্প আর কিছুই নেই। চেয়ারে সোজা হয়ে বসুন আর আপনার অনভ্যস্ত হাতটি কাগজ বা খাতাটি ধরে রাখার কাজে ব্যবহার করুন। এটা আপনাকে স্থির থাকতে এবং যে হাত দ্বারা লিখছেন সে হাতের উপর নিয়ন্ত্রন বাড়াতে সাহায্য করবে।
(১১) ফাঁক রেখে লিখুন
শব্দ থেকে শব্দ এবং লাইন থেকে লাইনের মাঝে কিছুটা ফাঁক রেখে লিখুন। আপনার লেখাটিকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করতে এভাবে লেখা খুব জরুরী।
হিজিবিজি করে লেখা আর আরশোলার পায়ে কালি মাখিয়ে সাদা কাগজে ছাপ তোলা একই কথা। আপনার লেখা যতই খারাপ হোক এভাবে লিখলে কখনই তা বুঝতে কাউকে খুব একটা কষ্ট করতে হবে না।
(১২) আকর্ষণীয় মার্জিন করুন
লেখার শৃঙ্খলা রক্ষার্থে আর লেখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য খাতায় মার্জিন করুন। লেখা শুরু করার আগেই খাতার একদম উপরে এবং বাম পাশে এক স্কেল পরিমান মার্জিন করুন। আর মার্জিনটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে নিল কালির কলম ব্যবহার করুন। পাশাপাশি দুটো দুটো করে দাগ দিলে সৌন্দর্য আরো বেশি বৃদ্ধি পাবে।
মার্জিন দেয়ার ক্ষেত্রে পেন্সিলও ব্যবহার করা যায়। অনেক পাবলিক পরীক্ষায় নীল কালির কলমে নিষেধাজ্ঞা থাকে। কাজেই এসব ক্ষেত্রে পেন্সিল ব্যবহার করাই শ্রেয়।
(১৩) লেখায় দিন রঙের স্পর্শ
কেবল এক রঙের কালি দিয়ে লেখার চেয়ে দুই বা তার চেয়ে বেশি রঙের কালি দিয়ে লিখলে লেখা হয়ে উঠবে আরো বেশি নজর কাড়া ও আকর্ষণীয়।
শিক্ষকরা অনেক অনেক খাতা মুল্যায়ন করেন। তাই সব গুলো খাতা খুব ভালোভাবে পড়ে মুল্যায়ন করার মতো ধৈর্য তাদের থাকে না বললেই চলে। এখানেই সুযোগ পেয়ে যায় নজরকাড়া ও আকর্ষণীয় লেখার অধিকারী মানুষগুলো।
আপনার লেখাটিও যেন সঠিকভাবে মূল্যায়ন হয় সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বা বাক্যগুলো নীল কালির কলম দিয়ে লিখুন আর পরীক্ষার খাতায় নিজের লেখার প্রতি শিক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করুন।
(১৪) পয়েন্ট করে লিখুন
আপনার লেখার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো পয়েন্ট ব্যবহার করে লিখুন। এতে আপনার লেখাটি যেমন গঠনমূলক হয় তেমনি লেখার যুক্তিগুলো ফুটে উঠে সুনির্দিষ্টভাবে। পরীক্ষার খাতায় এরকম পয়েন্ট করে লেখার গুরুত্ব অনেক বেশি।
কম কথায় আর কম বাক্য ব্যয়ে বেশি নম্বর পেতে চাইলে পরীক্ষার খাতায় অবশ্যই পয়েন্ট করে লিখুন। এতে আপনার লেখার নান্দনিকতা বাড়ার পাশাপাশি উত্তরপত্র মূল্যায়নকারী পরীক্ষকের সন্তোষজনক দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবেন খুব সহজেই।
(১৫) ধীরে ধীরে গতি বাড়ান
হতের লেখা মোটামুটি সুন্দর হবার পর ধীরে ধীরে গতি বাড়ানোর চেষ্টা করুন। আগেতো বেশ আস্তে আস্তে সুন্দর করে লিখতেন, এবার তার চেয়ে একটু কম সময় নিয়ে লেখার চেষ্টা করুন।
আপনার এক পাতা লিখতে ঠিক কত সময় লাগে? সে সময়টি নোট করে রাখুন আর পরবর্তীতে চেষ্টা করুন ওই একই লেখা আরো কম সময়ের মধ্যে শেষ করার। খেয়াল রাখবেন, দ্রুত লিখতে যেয়ে আবার লেখার সৌন্দর্য নষ্ট না হয়ে যায়!
পরিশেষে
লেখা সুন্দর করার মূল মন্ত্র হলো অনুশীলন, অনুশীলন আর অনুশীলন! এর বিকল্প কোন পথ নেহায়েত কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না। একদিনে দশ পাতা লিখবেন আর দুই দিন কিছুই না লিখে চুপচাপ বসে থাকবেন, এমনটি করলে কিন্তু চলবে না। তাই শত ব্যাস্ততার মাঝেও লেখা সুন্দর করার চর্চা ভুলবেন না যেন!
লেখকঃ মোঃ তোফায়েল আহমেদ
ই-মেইলঃ tofayelahmed89573@gmail.com