ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে যুগ যুগ ধরে হলুদ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। দাগহীন উজ্জ্বল ত্বক পেতে হলুদের জুরি নেই। আজকের আলোচনায় ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করার উপায় হিসেবে ৫টি কার্যকর হলুদের ফেইসপ্যাক এর প্রস্তুত পদ্ধতি ও ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
হলুদ কমবেশি আমাদের সবার কাছেই একটি অতি পরিচিত উপাদান। প্রাত্যহিক রান্না থেকে শুরু করে রুপচর্চায়ও এর ব্যবহার প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করার উপায় হিসেবে হলুদের বিশেষ কার্যকারিতা রয়েছে; যার জন্য ত্বক ফর্সাকারী বিভিন্ন ক্রিমেও হলুদ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
হলুদে আছে কারকিউমিন নামক একটি বিশেষ উপাদান, যা শুধুমাত্র হলুদেই পাওয়া যায়। এটি ত্বককে ভেতর থেকে ফর্সা করে ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে থাকে।
কারকিউমিন আমাদের ত্বকের ব্যাকটেরিয়া দূর করে ও ত্বক পাতলা করে। যার কারণে ত্বকের লাবণ্য ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়।
হলুদের ভেষজ গুণ
- ঘুমানোর আগে নিয়মিত দুধের সাথে কাঁচা হলুদ মিশিয়ে খেলে রক্ত পরিষ্কার হয় ও ত্বক ফর্সা হয়।
- প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ৩-৪ চামচ কাঁচা হলুদের রস খেলে বয়সের ছাপ দূর হয় এবং তারুণ্যতা ফিরে আসে।
- কাঁচা হলুদে আছে এন্টিস্যাপ্টিক ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি উপাদান, যা ব্রণ ও ব্রণের দাগ কমায়।
- এছাড়াও রিঙ্কল, সান ট্যান, চর্মরোগ, প্রদাহ, ফুসকুড়ি, দাগ ইত্যাদি দূর করতেও হলুদ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে।
ঝলমলে উজ্জ্বল ত্বক পাওয়ার জন্য আমরা কত-শত কেমিকেল প্রোডাক্ট ব্যবহার করি তার হিসেব নেই। অথচ ঘরোয়া প্যাক ব্যবহার করতেই যতো টালবাহানা!
রঙ ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার করা আর জেনেশুনে আগুনে ঝাপ দেওয়া দুইটার মধ্যে আদৌ কোনো পার্থক্য নেই। এসব ক্রিমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে না হয় নাই বলি; সেটা আপনারা সবাই কমবেশি জানেন।
তবে বাজারের বিভিন্ন দামি ব্র্যান্ডের প্রোডাক্টের চেয়ে ঘরোয়া উপাদানে ত্বকের যত্ন নিলে সেটা বহুগুণ কার্যকর এটা তো মানতেই হবে। ঘরোয়া পদ্ধতিতে রূপচর্চায় ধীরে ধীরে ত্বকের ভেতর থেকে লাবণ্য বাড়ায় এবং এগুলো দীর্ঘস্থায়ী।
অনেকের কাছেই ঘরোয়া উপকরণ ব্যবহার করে রূপচর্চা করাটা ঝামেলা মনে হয়। তবে উজ্জ্বল দীপ্তিমান ত্বক পেতে একটু তো ঝামেলা পোহাতেই হবে, কি বলেন?
বেশি না। সপ্তাহে ২ দিন আপনার ত্বককে ন্যাচারাল প্রোডাক্ট দিন, পার্থক্যটা মাস না পেরোতেই বুঝতে পারবেন। ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করার উপায় এবং একই সাথে ত্বকের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে আজকের আর্টিকেলটিতে আপনাকে জানানো হবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও পরিচিত ভেষজ হলুদের ৫টি ফেইসপ্যাকের কথা!
আরও পড়ুন-
- সানস্ক্রিন কিভাবে সূর্যের আলো থেকে ত্বক রক্ষা করে?
- চোখের নিচে কালো দাগ দূর করার উপায়
- রূপচর্চায় গোলাপজলের সেরা ৯টি ব্যবহার
তাহলে চলুন দেরি না করে জেনে নেওয়া যাক –
হলুদের ৫টি ফেইসপ্যাক তৈরি ও ব্যবহার করার পদ্ধতি : ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করার উপায়
০১। টকদই, হলুদ বাঁটা ও মধুর ফেইসপেক
প্রথমে ২কাপ পানিতে ৩ চামচ গোলাপ জল মিশিয়ে মুখ পরিষ্কার করে নিতে হবে। এরপর ৫-৬ চামচ টকদই, ১চামচ হলুদ বাঁটা, ১ চামচ মধু ব্লেন্ডারে অথবা চামচ দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। মুখ মুছে এই প্যাকটি সমানভাবে পুরো মুখে লাগাতে হবে। এক্ষেত্রে ব্রাশ ব্যবহার করাই উত্তম।
প্যাকটি ১৫-২০ মিনিট রেখে ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এই প্যাকটি শুষ্ক ত্বকের জন্য অনেক বেশি কার্যকরী। তবে তৈলাক্ত ত্বকেও এটি অনেক ভালো কাজ করবে। সেক্ষেত্রে উক্ত উপাদানগুলোর সাথে ২ চামচ ময়দা মিশিয়ে নিতে হবে।
দইয়ের মধ্যে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়া বিভিন্ন ক্ষতিকর জীবাণুর সাথে লড়াই করে ব্রণের দাগ দূর করে ও ব্রণ প্রতিরোধ করে। এছাড়াও এতে রয়েছে ল্যাকটিক অ্যাসিড যা মৃতকোষ দূর করে ও ত্বককে উজ্জ্বল করে।
মধুর গুনাগুনের কথা বলে শেষ করা যাবে না। এর উপকারিকার কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি। মধু প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার যা আমাদের ত্বককে কোমল ও প্রানবন্ত করে তোলে।
মধু আমাদের ত্বকের বলিরেখা, কালচেভাব ও ব্রণের জীবাণু দূর করে ত্বকের উজ্জ্বলতা ও আকর্ষণীয়তা ফিরিয়ে আনে। সপ্তাহে ২ বার নিয়মিত এই প্যাকটি ব্যবহার করলে দ্রুত তফাৎ বুঝতে পারবেন।
০২। হলুদ বাঁটা, চালের গুঁড়া ও কাঁচা দুধের ফেইসপ্যাক
৩ চামচ হলুদ বাঁটা, ২-৩ চামচ চালের গুড়ো ও পরিমাণ মতো কাঁচা দুধ একত্রে মিশিয়ে প্যাক বানিয়ে নিন । এবার মুখ পরিষ্কার করে প্যাকটি ২০ মিনিটের জন্য রেখে স্বাভাবিক মাত্রার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। কাঁচা দুধে আছে ল্যাকটিক অ্যাসিড, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-ডি, ভিটামিন-বি৬, ভিটামিন বি১২ ইত্যাদি উপাদান।
এটি শুষ্ক ত্বককে কোমল করে। ত্বকের আদ্রতা বজায় রাখে। দাগ দূর করে। সান ট্যান দূর করে। কাঁচা দুধ ক্লিঞ্জার, টোনার, ময়েশ্চারাইজার ৩টির কাজ একাই করতে পারে৷
চালের গুড়োতে নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা ত্বকে ক্লিঞ্জারের কাজ করে। ব্লাক হেডস কমায়। ব্রণের দাগ কমায়। ত্বককে মসৃণ করে ও ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
সাথে হলুদের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুন তো আছেই। আরো আছে কারকিউমিন নামক ত্বক ফর্সাকারী উপাদান। সব গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো মিলিয়ে এই ফেইসপ্যাকটি তৈরি হওয়ায় এটি ত্বকের লাবণ্য বৃদ্ধি করে ও বয়সের ছাপ কমায়। সর্বোচ্চ ফলাফল পেতে এই প্যাকটি সপ্তাহে ২ বার নিয়মিত ব্যবহার করুন।
০৩। হলুদ বাঁটা, কমলার রস ও মধুর ফেইসপেক
২চামচ হলুদ বাঁটা, ১ চামচ কমলার রস ও ১ চামচ মধু মিশিয়ে একটি প্যাক তৈরি করে নিন। এরপর ভালোভাবে মুখ ধুয়ে প্যাকটি মুখ ও গলায় একটি ব্রাশের সাহায্যে লাগিয়ে নিন। প্যাকটি লাগিয়ে ২০ মিনিট রেখে ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এই প্যাকটি সপ্তাহে ২ বার ব্যবহার করুন।
কমলাতে রয়েছে ভিটামিন-সি, বিটা ক্যারোটিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ইত্যাদি। এই উপাদানগুলো ত্বকের বলিরেখা কমায়, বয়সের ছাপ দূর করে এবং ত্বককে করে মসৃণ ও লাবণ্যময়ী।
মধুতে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ত্বকের ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করে ত্বককে সুরক্ষা করে ফলে ব্রণ দূর হয়। এছাড়াও এতে থাকা নানা পুষ্টি উপাদান ত্বককে প্রাণবন্ত ও মোলায়েম করে।
কমলার রসে যেহেতু ভিটামিন-সি আছে তাই এই প্যাকটি রাতে লাগালেই অধিক কার্যকর ফলাফল পাবেন। ভিটামিন-সি ত্বকের জন্য খুবই উপকারী তবে সূর্যের আলোয় এর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। সে জন্য এই প্যাকটি রাতে ব্যবহার করুন। এই প্যাকটি ব্যবহারে আপনার ত্বক তারুণ্যতা ফিরে পাবে ও ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হবে।
০৪। হলুদ বাঁটা, চন্দন গুড়ো, দই ও গোলাপজলের ফেইসপ্যাক
২ চামচ হলুদ বাঁটা, ২ চামচ চন্দন গুড়ো, ২ চামচ দই ও ১ চামচ গোলাপজল খুব ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। এবার মুখ ধুয়ে একটি পাত্রে পানি গরম করে তোয়ালে দিয়ে বড় ঘোমটা দিয়ে ভাপ নিন ৩-৪ মিনিটের মতো। এতে করে ত্বকের পোর্সগুলো খুলে যাবে এবং প্যাক ভালো কাজ করবে।
এরপর উক্ত ফেইসপ্যাকটি ব্রাশের সাহায্যে লাগিয়ে নিন। ১৫-২০ মিনিট রেখে ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। চন্দন সূর্যের ক্ষতিকর বেগুনি রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করে, ত্বকের প্রদাহ কমায়, মুখের ছোট ছোট ছিদ্র সংকোচন করে। এতে থাকা অ্যান্টিস্যাপ্টিক উপাদান ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করে এবং ব্রণ ও ব্রণের দাগ কমায়।
দই ত্বকেকে উজ্জ্বল করার পাশাপাশি ত্বকেকে কোমল করে একটা গ্লোয়িং ভাব আনে ত্বকে। গোলাপ জলে রয়েছে অ্যান্টি-এজেন্ট যা আমাদের ত্বকের ময়লা দূর করে ত্বককে সতেজ করে থাকে। গোলাপ জল ত্বকের জ্বালাপোড়া, সানবার্ণ, ত্বকের কালো দাগ, ব্রণ ও ব্রণের দাগ কমায়। দ্রুত ফর্সা ও ঝলমলে ত্বক পেতে এই অসাধারণ ফেইস প্যাকটি সপ্তাহে ২-৩ দিন লাগান।
০৫। হলুদ গুড়ো, অ্যালোভেরা জেল, আর্মণ্ড অয়েল ও কাঁচা দুধের ফেইসপ্যাক
২ চামচ হলুদ গুড়ো, ৪ চামচ অ্যালোভেরা জেল (এক্ষেত্রে বাজারের জেল ব্যবহার না করে সরাসরি গাছের সতেজ জেল ব্যবহার করুন), ১ চামচ আর্মণ্ড অয়েল বা বাদাম তেল এবং ১ চামচ কাঁচা দুধ একত্রে ভালো করে মিশিয়ে নিন। এবার হালকা গরম পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে প্যাকটি ব্রাশের সাহায্যে লাগিয়ে নিন। ২০ মিনিট রেখে ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। পরিবর্তনটা সাথে সাথে লক্ষ করতে পারবেন।
অ্যালোভেরাতে ক্লিঞ্জিং প্রপার্টি থাকায় এটি ত্বককে পরিষ্কার করে ত্বকের উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। এছাড়াও এটি সান বার্ন, সান ট্যান, ত্বকের প্রদাহ, ত্বকের ক্ষতিকর জীবাণু ইত্যাদি দূর করে ত্বককে প্রাকৃতিকভাবে ময়েশ্চারাইজ করে।
আর্মণ্ড অয়েলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় এটি বয়সের ছাপ দূর করে ও ত্বকে ভাঁজ পরতে দেয় না। এছাড়াও এটি মুখ ও চোখের নিচের কালো দাগ দূর করে, সানবার্ন কমায়, শুষ্ক ত্বকে কোমল ভাব আনে, ত্বকের গভীরে গিয়ে পুষ্টি যোগায় ও ত্বককে ভেতর থেকে উজ্জ্বল করে।
কাঁচা দুধ ত্বকের মৃত কোষ দূর করে। ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করে ও ত্বককে উজ্জ্বল করতে অনেক বেশি উপকারী। দুধে থাকা ল্যাক্টিক এসিড ত্বকের বলিরেখা ও বয়সের ছাপ কমায়। এছাড়াও রোদে পোড়াভাব, এলার্জি ইত্যাদি দূর করে। বিভিন্ন ফেইস প্যাকে দুধ ব্যবহার করলে তার কার্যকারিতা অনেক বেশি বেড়ে যায়। উজ্জ্বল ফর্সা ত্বক পেতে এই প্যাকটি সপ্তাহে ২ বার নিয়মিত ব্যবহার করুন।