আপনি কি নিজেকে পিছিয়ে পড়া মানুষদের একজন মনে করছেন? ‘আমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না’ এরকম সব আজগুবি চিন্তা কি আপনার উপর জেঁকে বসেছে? অন্যের সাথে নিজের তুলনা করে প্রতিনিয়তই হতাশার শিকার হচ্ছেন? তাহলে প্রথমেই নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে করুন।
আত্মবিশ্বাসের অনুপ্রেরনা
জীবনের ব্যর্থতা নামক বিষফোঁড়াটি যখন ধিরে ধিরে ক্যান্সারের রুপ ধারণ করে ধ্বংসের কারণ হয়ে দাড়ায়, তখন খাম-খেয়ালি চিন্তা বা ঠুনকো আবেগ দিয়ে আর কাজ হয় না; প্রয়োজন হয় অনুপ্রেরনা নামক কোমোথেরাপির। সেই থেরাপি দিতেই এই সুদীর্ঘ প্রবন্ধটি লেখা। আপনার বিষফোঁড়ার প্রকার ও গভীরতা বুঝে জেনে নিন প্রতিকার।
“আপনি” এক অনন্য সত্তা
আপনার ঘরে নিশ্চয়ই আয়না আছে, আয়নার সামনে দাড়িয়ে একবার নিজের দিকে দেখুন। হয়তো আপনি ফর্সা বা কালো কিংবা শ্যাম বর্ণ, এবার চোখ মেলে একটু আশেপাশে চেয়ে দেখুন– কারো শরীরের রং-ই
কিন্তু এক নয়, সকলেরই ভিন্ন ভিন্ন। মেধা বা বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারটিও ঠিক তাই। উভয়ই সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নির্ধারিত, কাজেই অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করা চলে না! আপনি নিজের মাঝেই নিজে এক অনন্য সত্তা!
আপনি কি নিজেকে চেনেন?
সফলতার সিঁড়িতে পা দেয়ার পূর্বে আপনার নিজেকে
জানতে হবে। নিজের সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা আপনাকে রাখতে হবে। আপনি কি পারবেন মাত্র তিনটি শব্দের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে? যদি না পারেন তাহলে বুঝতে হবে আপনার নিজের সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা নেই। সকলের চেয়ে ভিন্ন ও আকর্ষণীয় ভাবে নিজেকে গড়ে তুলুন।
নিজস্ব একটি ডায়েরি নির্বাচন করুন, আর প্রতিদিন সেখানে আপনার নিজের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গুলি লিখে রাখুন, যার দ্বারা আপনাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব! আর সপ্তাহে অন্তত একটিদিন একবারের জন্যে হলেও সেই ডায়রিটি পড়ুন।
আপনি কি আপনার গুণগুলো সম্পর্কে জানেন?
প্রতিটি মানুষ নিজ গুণে গুণান্বিত। আপনারও নিজস্ব গুণ আছে। আপনি কি জানেন সেই গুনগুলো কি কি?
হতে পারে সেই গুনটি সকলের চেয়ে ব্যাতিক্রম!
একদিকে স্যার জগদীশ চন্দ্র যেমন ভেবেছিলেন বিজ্ঞান নিয়ে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন সাহিত্য নিয়ে। উভয়ের চিন্তাধারা ভিন্ন, গুণ ভিন্ন। অনুরুপ প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব গুণ আছে, আর আছে ব্যাতিক্রমী চিন্তাধারা। আর এই ব্যাতিক্রমী চিন্তাধারা ছিল বলেই মনুষ্য জাতি আজ এত সমৃদ্ধ । নিজের গুনগুলি উপলব্ধি করুন, আর যত বাঁধাই আসুক না কেন সেগুলোর প্রতি অটল থাকুন।
আপনার খারাপ অভ্যাসগুলি চিহ্নিত করুন
আপনার খারাপ অভ্যাসগুলি পর্যবেক্ষণ করা শুরু করুন। কোন কাজগুলো করলে আপনি শেষ পর্যন্ত ভালো বোধ করেন না, সেগুলো বিবেচনা করুন। এমন কোন কাজ আছে কি, যা আপনি দীর্ঘদিন যাবৎ বেশ আগ্রহের সাথে করে আসছেন অথচ তা আপনার জন্য মোটেও মঙ্গলজনক নয়? তাহলে সে কাজটি খুব দ্রুতই আপনাকে বর্জন করা উচিৎ। নইলে এমনও হতে পারে যে, সামান্য কিছু বদ অভ্যাস আপনার ভবিষ্যৎ জীবনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। মনে রাখবেন,
‘লেবু বেশি কচলালে তেঁতো হয়ে যায়!’
লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করুন
আপনার জীবনের লক্ষ্যই আপনার সফলতার মূল অনুপ্রেরণা
মনে করুন আপনার ঘরে চাল, ডাল, আটা, চিনি ইত্যাদি খাবার তৈরির সমস্ত সরঞ্জামই আছে, কিন্তু আপনি ততক্ষণ খাবার তৈরির কথা ভাববেন না যতক্ষণ না আপনার ক্ষুধা লাগে।
আর এই ক্ষুধাই হল আপনার খাবার তৈরির পেছনের মূল অনুপ্রেরণা। অনুরূপভাবে আপনি যখন একটি লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করবেন, তখন সে লক্ষ্যটিই আপনাকে মূল অনুপ্রেরণা যোগাবে, যার দ্বারা আপনি সকল প্রকার অসাধ্য সাধন করার এক আত্মিক শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হবেন।
কাজেই এখনই আপনার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে একটি কাগজে লিখে ফেলুন । আর সে লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্য আপনি কি কি করছেন তার একটি তালিকা তৈরি করুন। আর ভাবতে থাকুন আপনার ঠিক আর কি কি করা উচিত?
উদ্দেশ্য নির্ধারণ করুন
লক্ষ্য নির্ধারণ ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ কিঞ্চিত আলাদা দুটি বিষয়। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মাঝে কিছু সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে। যেমন, লক্ষ্য হল আপনি যা অর্জন করতে চান তার তালিকা, আপনি এগুলিকে দৈনিক, মাসিক, বাৎসরিক বা একটি সংমিশ্রণে সেট করতে পারেন।
আর উদ্দেশ্য নির্ধারণ এর সময় আপনি ঠিক করেন যে কোন ধরণের ইতিবাচক অনুভুতি বা আবেগ আপনি চাইছেন। উদাহরণ স্বরূপ, ‘এই সপ্তাহে আমার উদ্দেশ্য বন্ধুদের সাথে দুইবার পাহাড়ে যাওয়া। আমার এই মাসের উদ্দেশ্য হল আমার সেই সকল সহকর্মীর সাথে সদাচারন করা যাদের দ্বারা আমি অপমানিত হয়েছিলাম’।
লক্ষ্যের চেয়ে উদ্দেশ্য অর্জন বেশি প্রেরণাদায়ক হতে পারে। কারণ, আপনি যদি নিজের লক্ষ্য অর্জন করতে না পারেন, তবে এটি আপনাকে ব্যর্থতার মতো অনুভব করাতে পারে। শেষপর্যন্ত এই ব্যর্থতা আপনাকে পিছিয়ে ফেলতেও পারে। কিন্তু যদি নির্দিষ্ট উপায়ে কোনকিছুর কাছে পৌঁছানোর আপনার উদ্দেশ্য অর্জন করতে না পারেন, তবে আপনি খুব সহজেই পুনরায়ই দলবদ্ধ হয়ে আবার চেষ্টা করতে পারেন।
আপনি যদি সর্বোত্তম ভাবে আপনার উদ্দেশ্য গুলো পূরণ করতে চান, তাহলে নির্দিষ্ট সপ্তাহ বা দিনের উদ্দেশ্য গুলি একটি কাগজে লিখে রাখুন। আর প্রতিদিন কোন এক সময় চেষ্টা করুন সেই উদ্দেশ্য গুলো বিশ্লেষণ করে আর কি সহজ পথ বেঁছে নেয়া যায়।
আপনার ত্রুটিই আপনার সম্পদ
আমরা মানুষ, আমরা কেউই ত্রুটি মুক্ত না। আপনি যদি আমাকে এমন একজন মানুষের সন্ধান দিতে পারেন যে নিজেকে ত্রুটি মুক্ত হিসেবে দাবি করে তাহলে আমিও আপনাকে একটা চরম মিথ্যেবাদি লোকের সন্ধান দিতে পারবো। নিজের ত্রুটি গুলোকে নিজের এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করুন।
হতে পারে আপনি কৃষ্ণাঙ্গ, আপনার মুখে জড়তা আছে। আপনি অন্যদের সাথে টেক্কা দিয়ে সবসময় সব কিছু করতে পারেন না। তাতে কি হয়েছে? ত্রুটির ঊর্ধ্বে কেউই নেই। আপনার ত্রুটিই আপনার সম্পদ। আর এই ত্রুটিই আপনাকে করেছে সকলের চেয়ে অনন্য। কাজেই হতাশ হয়ে লাভ নেই,আপনার ত্রুটিগুলোকে স্বাদরে গ্রহণ করুন।
শিক্ষা গ্রহন করুন সমালোচনা থেকেই
উন্নতির পথের সবচেয়ে বড় কাঁটা হল “পাছে লোকে কিছু বলে”। সমালোচনা করা যেমন খুব সহজ, তেমনি এটি পৃথিবীর জঘন্যতম কাজগুলোর একটি।
সমালোচনা ন্যায় সঙ্গত হোক বা না হোক, কেউ যদি আপনার ব্যাক্তিত্ব ও বোধ বুদ্ধিকে অবমাননা করে, আপনার পোশাকটি নিয়ে উপহাস করে তবে এই কথা শতভাগ সত্য যে আপনি মানসিক ভাবে আঘাত পাবেনই পাবেন! এক্ষেত্রে নিজের মনের ছাঁকনাটি ব্যবহার করুন।
নিজের বিবেচনাবোধ দ্বারা ছেঁকে দেখুন আপনি যা করছেন বা করতে চলেছেন তা আপনার ব্যাক্তি জীবন ও সমাজের জন্য ঠিক কতটা মঙ্গলজনক বা হানিকারক।
যদি সেটি মনঙ্গলজনক হয় তবে যেকোন মুল্যে তা গ্রহন করুন, অন্যথায় বর্জন করুন। এই সমালোচক দলের লোকেরাই আপনার এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহনে এক ভিন্নধর্মী সহায়ক ভুমিকা পালন করবে।
আর সে জন্যেই কবিগুরু বলেছেন,
খুশি থাকুন সব সময়
মানুষ রক্ত মাংসের তৈরি এ কথা যেমন সত্য। সুখ, দুঃখ তার নিত্য সঙ্গি একথাও ঠিক তেমনি সত্য। সুখ কিংবা দুঃখ কোনটিই সমান ভাবে স্থায়ী থাকে না। কিন্তু আপনি ইচ্ছে করলেই সুখি থাকতে পারবেন সবসময়, আর এই সুখ হল আত্মিক সুখ।
প্রতিদিনে ঘটে যাওয়া ভালো–মন্দ প্রতিটি ঘটনা থেকে ইতিবাচক দিকটি উন্মোচন করুন। এতে আপনার জন্য জীবনের অর্থ যেমন খুব সহজ আর সাবলিল হয়ে যাবে, তেমনি জীবন থেকে পাবেন এক অমোঘ শিক্ষা।
আর প্রতিদিন ঘুমোতে যাবার পূর্বে অন্তত একবারের জন্য হলেও অতীতে ঘটে যাওয়া সুখকর ঘটনা গুলি স্মরণ করুন। আর জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন।
আপনি কেন হেরে যাবেন?
বিখ্যাত সেলস ট্রেইনার রাজিব আহমেদ তার একটি বইয়ে লিখেছিলেন,“আপনার পিতার ৫০ কোটি শুক্রাণুর মধ্যে একটি শুক্রাণু বিজয়ী হয়ে আপনার মা’র গর্ভাশয়ে পৌঁছেছিলো, সেই শুক্রাণুটিই আজকের আপনি।
সুতরাং, স্রষ্টা আপনাকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন বিজয়ী করে। আপনি কেন হেরে যাবেন? স্রষ্টা আপনাকে বিজয়ী করে তার কাছে ফেরত নিতে। আপনি যদি হার না মানেন, আপনাকে হারানোর হ্মমতা কারো নেই”। কাজেই নিজেকে জাগিয়ে তুলুন, হেরে যাবার জন্য আপনার জন্ম হয়নি! আপনি হারতে পারেন না!
শেষ কথা
আপনার অনুপ্রেরণা আপনিই! জাগিয়ে তুলুন নিজের আমিত্বকে। জীবনের চলার পথটি মসৃণ নয়, কিন্তু সামান্য একটু আত্মিক শক্তিই পারে এই অমসৃণ পথটি সাবলিল করতে। একটি গাছ বেড়ে ওঠে আপন মনে, কখনো যত্ন পায়, কখনও পায় না! ঠিক তেমনি আপনাকেও বেড়ে উঠতে হবে আপন মনেই। স্বপ্ন দেখুন, স্বপ্ন পূরণও করুন।
কেননা,
‘ইচ্ছেরা বাঁধাহীন,
স্বপ্নেরা সীমাহীন’।
প্রয়োজন মনে হলে পড়ে দেখতে পারেন –