সুস্বাস্থ্য লাভের জন্য করণীয় কি? জেনে নিন বিস্তারিত সবকিছু!

স্বাস্থ্য; আমরা সবাই পরিচিত এই শব্দটির সঙ্গে। যা আমাদের জীবনের প্রতি মূহুর্তের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি এ সম্পর্কে? শুধু তর্কের খাতিরে স্বাস্থ্য সচেতন বলে নিজেকে দাবি করাটাই যেন আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তি জীবনে সুস্বাস্থ্যের প্রয়োজন যে কতোটা, তা অনুধাবন করানোর জন্যই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।

WHO কর্তৃক ১৯৪৮ সালে ঘোষিত সংজ্ঞা অনুযায়ী, “স্বাস্থ্য বলতে সম্পূর্ণ শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক কল্যাণবোধকে বোঝায়। শুধু রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতিকেই স্বাস্থ্য বলে না।”

আবার, ১৯৮৬ সালে WHO স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সংজ্ঞা পরিবর্তন করে।

“স্বাস্থ্য দৈনন্দিন জীবনের একটি সম্পদ, এটা বেঁচে থাকার কোনো উদ্দেশ্য নয়। সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে স্বাস্থ্য একটি ইতিবাচক ধারণা যা শারীরিক ক্ষমতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করে।”

এর অর্থ হলো, একটি বৃহত্তর সমাজে একজন ব্যক্তির অবস্থান অনেকাংশেই তার স্বাস্থ্যের উপর নির্ভরশীল। একজন অসুস্থ মানুষের অনেক অর্থ-সম্পদ থাকলেও সমাজে তার মূল্য অনেক নিচে নেমে আসে। একটি পরিপূর্ণ জীবনের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা খুবই প্রয়োজনীয়। সম্প্রতি গবেষকরা আরেকটা সংজ্ঞা দিয়েছেন,

“স্বাস্থ্য হচ্ছে নতুন নতুন বাধা এবং দুর্বলতার সাথে খাপ খাইয়ে সুস্থভাবে জীবনযাপন করা।”

তাদের এই ধরণের ধারণার কারণ হচ্ছে, গত কয়েক যুগ ধরে বিজ্ঞানের সুবাদে মানুষের মধ্যে রোগ-বালাই নিয়ে অনেক সচেতনতা তৈরি হয়েছে। তাই এখন আর রোগ থেকে বেঁচে থাকাকেই স্বাস্থ্য বলে না। সব ধরণের বাধা-বিপত্তিকে কাটিয়ে উঠে সুন্দরভাবে শরীর ও মন পরিচালনাকে স্বাস্থ্য বলে।

স্বাস্থ্যের প্রকারভেদ

এতক্ষণ আমরা স্বাস্থ্য কি তা নিয়ে আলোচনা করলাম। এখন আমরা দেখব স্বাস্থ্য কত প্রকার ও কী কী।
সাধারণত স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকেই বোঝায়। কিন্তু মানুষের এই দুই ধরনের স্বাস্থ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য আধ্যাত্মিক নিরাময়, আর্থিক সচ্ছলতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এখন আমরা জানব শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বলতে কি বোঝায়।

শারীরিক স্বাস্থ্য

শারীরিক স্বাস্থ্য বলতে শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে কাজ করাকে বুঝায়। আমাদের জীবনে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকাটা অবশ্যই জরুরি। শরীর সুস্থ না থাকলে কোনো কাজই সঠিকভাবে করা যায় না।

জীবনের প্রত্যেকটা মুহূর্তে শরীরের সুস্থতা খুবই প্রয়োজনীয়। কিন্তু এই শরীরকে সুস্থ রাখতে হলে আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। একজন মানুষ শারীরিকভাবে সুস্থ এবং তার প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে কাজ করছে, তার কারণ শুধুমাত্র রোগমুক্ত থাকা নয়। বরং প্রাত্যাহিক ব্যায়াম, পুষ্টিসম্পন্ন খাবার এবং পরিপূর্ণ বিশ্রামের ফলেই তা সম্ভব হয়েছে।

এখন কথা হচ্ছে আমরা শারীরিক স্বাস্থ্যবিধি কেনো মানবো? এর উত্তর জানার পূর্বে আমরা শারীরিক স্বাস্থ্যবিধি কি সেটা জেনে নিই।

শারীরিক স্বাস্থ্যবিধি

শারীরিক স্বাস্থ্য বিধি হচ্ছে একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা যা শরীরের রোগ ব্যাধি হওয়ার আশংকা কমিয়ে দেয়। শারীরিক সুস্থতার মধ্যে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃদকার্য, পেশি শক্তি, নমনীয়তা ও দৈহিক গঠন নির্ভর করে। শারীরিক সুস্থতা শরীরের বিভিন্ন রোগ-ব্যধির ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। তাই শারীরিক সুস্থতার জন্য আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত।

মানসিক স্বাস্থ্য

মানসিক স্বাস্থ্য বলতে একজন মানুষের আবেগিক, সামাজিক এবং মানসিক সুস্থতাকে বোঝায়। একজন মানুষের পরিপূর্ণ এবং সক্রিয়ভাবে জীবন-যাপনের জন্য শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতাও প্রয়োজন।

মানসিক স্বাস্থ্যকে সংজ্ঞায়িত করা শারীরিক সুস্বাস্থ্যের তুলনায় একটু কঠিন। কারণ, ব্যক্তিবিশেষে মানসিক সুস্থতা নির্ভর করে।

প্রতিটা মানুষের আবেগ, আনন্দ, বেদনা, চিন্তা-ধারা ভিন্ন। তাই প্রত্যেকটা মানুষের মানসিক সুস্থতা তার নিজের উপর নির্ভর করে। একজন ব্যক্তি তার অবস্থার উপর সে কতটুকু খুশি, সেটার উপরই তার মানসিক সুস্থতা নির্ভর করে। মানসিকভাবে সুস্থ না হলে সে শারীরিকভাবেও সুস্থ থাকতে পারবে না।

সবসময় হাসি-খুশি থাকা, নিজের অবস্থার উপর ভরসা রাখা মানসিক চাপ ও মানসিক দূর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। আমাদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ণ বস্তু হচ্ছে আমাদের স্বাস্থ্য। এই স্বাস্থ্যকে রক্ষা করা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে একটা সুখী জীবন যাপন করাই আমাদের উচিত।

সু-স্বাস্থ্যের সু-নিয়ম

সব সৌন্দর্য এবং সব সুখের মূল সু-স্বাস্থ্য। সু-স্বাস্থ্য ছাড়া আপনার সব আয়োজনই বৃথা। তাই সবার আগে সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে। তারপর অন্যগুলো এমনিই চলে আসবে; যেমন কান টানলে মাথা আসে। আর এই সু-স্বাস্থ্যের জন্য চাই সু-নিয়ম।

স্বাস্থ্য সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। ইংরেজিতে একটি কথা আছে- “Health is wealth.”

এর অর্থ হল- স্বাস্থ্যই সম্পদ। আপাতদৃষ্টিতে টাকা, জমিজমা, সোনা দানা ও অন্যান্য সম্পদ মূল্যবান। বেশিরভাগ মানুষই এগুলোর প্রতি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কিন্তু যখন তাদের শারীরিক অসুবিধায় পড়তে হয় তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। তখন তারা উপলব্ধি করে স্বাস্থ্যই সম্পদ। তারা অন্য কিছু অর্জন করতে গিয়ে মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে ফেলেছেন।

বর্তমানে আপনি স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন না হলে ভবিষ্যতে আপনি এই মূল্যবান সম্পদ অনায়াসেই হারিয়ে ফেলবেন। তবে কিছু নিয়ম পালন করলে স্বাস্থ্য কে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

এই সু-নিয়মের টিপস গুলো মেনে চলা জরুরি।

সঠিক খাবার বাছুন

কম ফ্যাট জাতীয় খাবার বাছুন। মাংস বেশি খাবেন না। প্রচুর শাক-সবজি খান। ময়দার চেয়ে আটা বেশি পুষ্টিকর। তাই আটার রুটি খান। গোটা মুগ, ছোলা, রাজমা রাখুন প্রতিদিনের ডায়েটে।

যে খাদ্য সমষ্টি গ্রহণে ক্ষুধা মিটবে, প্রয়োজনীয় পরিমাণে তাপশক্তি পাওয়া যাবে এবং দেহের সার্বিক প্রয়োজন মিটবে, সেই সকল খাদ্য সমষ্টি অর্থাৎ সুষম খাদ্য খান।

দুধে প্রায় সকল খাদ্য উপাদান বিদ্যমান থাকে। কার্বোহাইড্রেট হিসেবে থাকে ল্যাক্টোজ ও দুগ্ধজাত শর্করা। প্রোটিন হিসেবে থাকে কেজিন ও অ্যালবুমিন। দুধে থাকে ছোট দানা আকারে দুগ্ধ চর্বি। খনিজ পদার্থ হিসেবে থাকে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস। ভিটামিট ‘সি’ ছাড়া সকল ভিটামিনই দুধে বর্তমান। এছাড়া দুধে থাকে প্রচুর পরিমাণে পানি। খাদ্যের সকল উপাদান দুধে বর্তমান থাকায় দুধকে আদর্শ খাদ্য বলা হয়। তাই খাদ্য তালিকায় দুধকে প্রাধান্য দিন।

ক্ষতিকর খাবার এড়িয়ে চলুন

ফাস্ট ফুডের রকমারি খাবার এড়িয়ে চলুন। এইসব খাবারে ক্ষতিকারক উপাদান বেশি থাকে। এ ধরনের খাবারে বীট লবণ, টেস্টিং সল্ট এসব থাকেই। এগুলো শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। রঙ দিয়ে পঞ্চব্যঞ্জনে সাজানো খাবার খাবেন না। যেকোনো ধরনের খাবার বাসায় তৈরি করে খাওয়ার অভ্যাস করুন।

সময়মত খান

কম করে হলেও ঠিক সময়ে খান। প্রতিদিন একই নিয়মে খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন। এতে শরীরের মেটাবলিজম বাড়ে, এনার্জি পাওয়া যায়। একবারে অনেক খাবার খাবেন না। তাতে শরীরের হজম করার শক্তি স্তিমিত হয়ে আসে।

শরীরে আলস্য আসে এবং ঘুম পায়। হঠাৎ করে বেশি খেলে শরীর তা সামলে নিতে পারে না। এবং প্রতিদিন যে সময় আপনার খাবার কথা সেই সময়ে আপনি না খেলেও আপনার শরীরের খাবার হজম করার যে জারক রস তা খাদ্য নালীতে পড়ে। তাই তখন খালি পেট থাকলে আপনার খাদ্যনালীতে সমস্যা হয়ে গ্যাসট্রিক আলসারে পরিণত হয়।

খাদ্য তালিকায় সব ধরনের খাবার রাখুন

প্রতিটি খাবারের খাদ্য মূল্য আছে; যা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়। তাই প্রতিদিন কম হলেও সব ধরনের খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন। তেল, ঘি, মাখন কিংবা মাংস খাদ্যতালিকা থেকে একেবারে বাদ দিয়ে দেবেন না। সবুজ শাকসবজি দুধ, ছানা, ডিম ফল পরিমিত পরিমাণে নিয়মিত খান। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।

বেশি বেশি পানি খান

আমাদের শরীরে খাদ্য তালিকার ৭০ ভাগই পানি। পানি শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় পানি কম খেলে ডিহাইড্রেশন হয়। ফলে জয়েন্ট পেইন, ক্র্যাম্প, মাথা ধরার সমস্যা দেখা দেয়। পানি কম খেলে কিডনী সমস্যা এবং জন্ডিস হতে পারে। বেশি পানি খেতে না পারলে পানি জাতীয় খাবার খান এবং রসালো ফল খান।

ধূমপান মুক্ত থাকুন

ধূমপান প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আমাদের প্রচুর ক্ষতি করে। তাই ধূমপান এবং ধূমপায়ী থেকে দূরে থাকুন। ধূমপান করলে ফুসফুসের প্রচন্ড ক্ষতি হয়। এমনকি ফুসফুসের ক্যান্সারও হতে পারে। একেবারে ছাড়তে না পারলে প্রতিদিন তালিকা থেকে একটা করে কমিয়ে দিন। এভাবে কমাতে কমাতে দেখবেন অবশেষে আপনার তালিকায় অবশিষ্ট থাকবে না।

প্রতিদিন ব্যায়াম করুন

সু-স্বাস্থ্য মানে বেশি মোটা কিংবা স্লিম হওয়া নয়। শরীর এবং মন সুস্থ থাকার নামই সু-স্বাস্থ্য। তাই শরীর এবং মন সুস্থ রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম করুন। কেউ মোটা বলে মোটা কমানোর জন্য ব্যায়াম করবেন তা কিন্তু নয়। সবার জন্যই ব্যায়াম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিয়মিত ব্যায়াম করলে শরীর সুস্থ থাকে, আলস্য দূর হয় এবং কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পায়।

নিয়মিত বিশ্রাম নিন এবং পরিমিত ঘুমান

যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন; তিন/চার ঘন্টা পর পর একটু বিশ্রাম নিন। বিশ্রাম নিলে কাজের একঘেঁয়েমি দূর হয় এবং কাজে ভুল কম হয় এবং পরবর্তীতে কর্মস্পৃহা সচল থাকে এবং বৃদ্ধি পায়। প্রতিদিন ৭/৮ ঘন্টা ঘুমান। ঘুম শরীর সুস্থ রাখে। পরের দিনের কাজের জন্য শরীরকে প্রস্তুত হতে সাহায্য করে। তাই কখনো নির্ঘুম থাকবেন।

সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে না তোলা আর অনিয়মের কারণে যাদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা সম্ভব হয় না, তাদের খাবারের তালিকায় কিছু খাবার রাখা খুবই জরুরি। এমনই কিছু খাবারের নাম উল্লেখ করে একটি তালিকা প্রকাশ করে ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ, অফিস অফ ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট।’

স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি ওয়েবসাইটের এক প্রতিবেদনে সেলেনিয়াম নামক একটি খনিজ উপাদানের নাম উল্লেখ করা হয় যা সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। তবে অতিরিক্ত সেলেনিয়াম আবার স্বাস্থ্যের ক্ষতিও করতে পারে।

‘দ্য সাপ্লিমেন্ট হ্যান্ডবুক’ বইয়ের লেখক ও ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের মেন’স হেল্থ প্রোগ্রামের সমন্বয়কারী ডা. মার্ক মোয়াদ বলেন, “যদি নিয়মিত প্রয়োজনের অতিরিক্ত সেলেনিয়াম গ্রহণ করা হয় তাহলে তা টাইপ টু ডায়বেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাছাড়া আরও কিছু ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ”তাই সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় হলেও অতিরিক্ত সেলেনিয়াম গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।

স্বাস্থ্য হলো মানুষ এবং তাঁর শরীরের মধ্যে একটি সম্পর্ক। সেই সম্পর্কটিকে সুস্থ রাখতে অবশ্যই ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্য মানুষের সুখ এবং কল্যাণের কেন্দ্রস্থল। এটি অর্থনৈতিক অগ্রগতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। যেহেতু স্বাস্থ্যকর জনসংখ্যা দীর্ঘজীবী হয়। ফলে আরও উৎপাদন এবং আরও বেশি কিছু সঞ্চয় করা সম্ভব হয়। আর সেই কারণেই প্রত্যেক বছর ৭ এপ্রিল সারা পৃথিবী জুড়ে পালন করা হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস।

১৯৪৮ প্রথম স্বাস্থ্য সমাবেশে এই দিনটির প্রয়োজনীয়তা আছে এই কথা উল্লেখ করা হয়। তারপর ১৯৫০ সাল থেকে প্রতি বছর এই দিনটি পালন হয়ে আসছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবায় সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাত, বিভিন্ন এনজিও ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। সরকারি খাতে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় নীতি প্রণয়ন, পরিকল্পনা এবং ব্যষ্টিক এবং সামষ্টিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনের ব্যাপারে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে।

মন্ত্রণালয়ের অধীনে চারটি অধিদপ্তর যথাক্রমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, নার্সিং সেবা অধিদপ্তর ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নাগরিকদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করে থাকে।

স্বাধীনতার পর হতে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সেবার উপর প্রভূত কাজ করেছে। সরকার সকল জনগণ বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মৌলিক স্বাস্থ্য সুবিধাসমূহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়নে কাজ করে যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও প্রজনন স্বাস্থ্যসহ পরিবার পরিকল্পনার বর্তমান অবস্থা বিশেষ করে নারী, শিশু ও প্রবীণদের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং শারীরিক, সামাজিক, মানসিক ও আত্মিক সুস্থতার ক্ষেত্রে টেকসই উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাত ‘এইচএনপি’ সেক্টরের মূল লক্ষ্য।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের অধীনে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি, জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নীতি এবং জাতীয় জনসংখ্যা নীতি বাস্তবায়িত হচ্ছে।

স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবায় গ্রাম ও শহর উভয় ক্ষেত্রে এনজিও সমূহের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। তারা মূলত: পরিবার পরিকল্পনা, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য অধিক্ষেত্রে কাজ করে থাকে। সাম্প্রতিককালে এনজিওসমূহ তাদের সেবার পরিধি বাড়িয়েছে এবং শহরে প্রাথমিক সেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কাজ করছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত পুনঃগঠনের ক্ষেত্রে ১৯৮২ সালে প্রণীত ঔষধ নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিলো ক্ষতিকর, মূল্যহীন ও অপ্রয়োজনীয় ঔষধ বাজার থেকে অপসারণ করা এবং স্বাস্থ্য সেবার সকল স্তরে প্রয়োজনীয় ঔষধ ন্যায্য মূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

১৯৮২ সালের জাতীয় ঔষধ নীতি সাফল্যজনকভাবে রূপায়নের ফলে বাংলাদেশে ফার্মাসিউটিকাল খাতে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে।

সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) সমূহ অর্জনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কিছু সূচক যেমনঃ শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, শিশু ও মায়েদের টীকা দেওয়া, ভিটামিন ‘এ’-এর ঘাটতি দূরীকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অসাধারণ অর্জন সাধিত হয়েছে। অন্যান্য সূচকসমূহে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকায় সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য সমন্বিত প্রয়াস গ্রহণ করতে হবে।

চিকিৎসা এবং অকাঠামো

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ২,৮৯৪ জনের জন্য রেজিষ্টার্ড চিকিৎসক আছেন মাত্র একজন৷ আর সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে ১,৬৯৮ জনের জন্য আছে একটি বেড৷ বাংলাদেশে মোট হাসপাতালের সংখ্যা সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে ৩,৫৭৫টি৷ এরমধ্যে সরকারি হাসলপাতাল মাত্র ৫৯২ টি৷

সরকারি হাসপাতালের মধ্যে উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে হাসপাতাল আছে ৪৬৭টি আর ১২৫টি হাসপাতাল বিশেষায়িত এবং জেলা পর্যায়ে৷

আর এতে স্পষ্ট যে সরকারি স্বাস্থ্য সেবার চেয়ে বেসরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবার অবকাঠামো বেশি৷ এবং বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়বহুল ও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে৷ বেসরকারি খাতে ৫,২২০টি ডয়াগনস্টিক সেন্টার আছে৷ এর একাংশ আবার অনুমোদন ছাড়াই হাসপাতালের কার্যক্রমও পরিচালনা করে৷ তাদের সেবার মান নিয়ে আছে বিস্তর অভিযোগ৷

অভিযোগ রয়েছে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা সেখানে ঠিকমতো সেবা না দিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে বেশি আগ্রহী৷

বাংলাদেশে এখন ডেন্টাল সার্জন বাদে মোট নিবন্ধিত চিকিৎসকের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৭৭৬ জন৷ আর হাসপাতালে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে বেডের সংখ্যা ৯২,৮০৪ টি৷

বাংলাদেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক আছে৷ সেখানে কাজ করেন ১৩ হাজার ২৪০ জন কমিউিনিটি স্বাস্থ্যকর্মী৷ এসব ক্লিনিক প্রধানত মা ও শিশুদের সেবায় নিয়েজিত৷ শিশুদের প্রয়োজনীয় টিকা সরকারি উদ্যোগেই দেওয়া হয়৷

টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদশের সাফল্য ঈর্ষনীয়৷ এ ক্ষেত্রে সাফল্য প্রায় শতভাগ৷ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবার আরেকটি দিক হলো, এখন প্রায় ৯৭ ভাগ পরিবার নলকূপ বা ট্যাপের পানি পান করে ৷ আর ৬৩ ভাগ পরিবার স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার করে৷

স্বাস্থ্য খাতে বাজেট

স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ছে কিন্তু পর্যাপ্ত নয়। স্বাস্থ্য খাতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বরাদ্দ বেড়েছে৷ এই খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৭ হাজার ৪শ’ ৮৭ কোটি টাকা৷ গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বেশি৷ যা মোট বাজেটের ৫.৬ শতাংশ, গত অর্থ বছরের তুলনায় ১.৩ শতাংশ বেশি৷ স্বাস্থ্য খাতে গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল মোট ১২ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৪.৩ শতাংশ৷

আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সার্বিক উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে এ খাতের জন্য ১১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল, যা মোট বাজেটের ৪.৪৫ শতাংশ ছিল৷ এর আগে ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে মোট বাজেটের ৪.৮৬ শতাংশ বরাদ্দ ছিল৷

দুর্নীতি, অনিয়ম

টিআইবি’র প্রতিবেদনে বলা হয়,স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে ১০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিতে হয়৷ সরকারি প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগনির্ণয় কেন্দ্র ও দালালদের কমিশন ভাগাভাগির সম্পর্ক রয়েছে৷

অ্যাডহক চিকিৎসক নিয়োগে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগে ১ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বলে জানায় টিআইবি৷

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, হাসপাতালে রোগীর পথ্যের সরবরাহকারী বাছাইয়ে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে৷ এতে সব ঠিকাদারের দরপত্রে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকে না৷ ঠিকাদার দরপত্র কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমঝোতা আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কাজ আদায় করে৷ দরপত্রে উল্লিখিত খাদ্যসহ নানা দ্রব্য সঠিকভাবে সরবরাহ করা হয় না৷

চিকিৎসকদের সঙ্গে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কমিশনভিত্তিক চুক্তি থাকে৷ এ কমিশনের হার নির্ভর করে কোন ডাক্তার কত রোগী পাঠায়, তার ওপর৷ এ কমিশনের হার ৩০ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত হয়৷ একইভাবে দালালদের কমিশন ১০ থেকে ৩০ ভাগ পর্যন্ত হয়ে থাকে৷

সরকারি চিকিৎসকরা বেসরকারি ক্লিনিক হাসপাতালেই সময় দেন বেশি৷ রোগীদের সেখানেই যেতে বলেন৷ বেসরকারি হাসপাতালে অনেক ক্ষেত্রে প্যাথোলজিস্ট না রেখে তাদের সিল ব্যবহার করে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রতিবেদন তৈরি করে রোগীদের রিপোর্ট দেওয়া হয়৷ আর সেখানে কোন পরীক্ষার কত খরচ তার কোনো নিয়মনীতি নেই৷ চিকিৎসকরাও মোটা অংকের ফি আদায় করেন৷

বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় অনেক চড়া হলেও মান দেখার যেন কেউ নেই৷

তবে যতো যাইহোক, স্বাস্থ্য যে আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ এটা সর্বজনস্বীকৃত। স্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। তাই যে কোনো মূল্যেই হোক, স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সকলের মৌলিক দায়িত্ব। কারণ, ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’।

Featured Photo by Zac Durant on Unsplash

লিখেছেন- তাহিয়া খান প্রভা

প্রাসঙ্গিক কিছু লেখা-

Leave a Comment