শীতে আদ্রতা পরিবর্তন হওয়ার কারনে দেখা দেয় নানা ধরনের অসুখ। যেমনঃ- জ্বর, ঠান্ডা, কাশি, অ্যাজমা, অ্যালার্জি, ডায়রিয়া, চর্মরোগ, ডেঙ্গু, ফাইলেরিয়া, ম্যালেরিয়া, ত্বক রুক্ষ হয়ে যাওয়া, খুশকি ইত্যাদি। শীতে বাতাসের আদ্রতা কম থাকে। বাতাসে প্রচুর ধুলোবালি উড়ে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে শীতে রোগের প্রকোপ একটু বেশিই দেখা দেয়। তাই শীতে সুস্থ থাকতে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়।
সুস্থ থাকতে ঋতু পরিবর্তনের এ সময় আমাদের সবারই সচেতন হওয়া উচিত। শীতকালে এসব রোগ থেকে বাঁচতে চাইলে প্রতিদিন ২ লিটারের মতো পানি পান করুন ও মৌসুমি শাকসবজি বেশি করে খান।
পাশাপাশি যে ৫টি খাবার বেশি বেশি নিয়মিত খেলে সুস্থ্য থাকতে পারবেন ও আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে সেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো –
শীতে সুস্থ থাকতে এবং প্রাণবন্ত জীবনের প্রয়োজনে খেতে পারেন এই ৫টি খাবার
০১। পালং শাক
পালং শাক একটি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু খাবার। শীতে পালং শাক অনেকটা সস্তায় পাওয়া যায়। তাই টাকা সাশ্রয়ের পাশাপাশি শীতে সুস্থ থাকতে এই শাকটি আপনার নিয়মত খাওয়া উচিত।
শীতে যেহেতু অ্যালার্জির প্রকোপ বেশি দেখা দেয় তাই যাদের অ্যালার্জির সমস্যা আছে, নিঃসন্দেহে তাদের একমাত্র বন্ধু হতে পারে পালং শাক। পালং শাক কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এতে পিত্ত রোগের সমাধান পাওয়া যায়।
সর্দি, কাশি, জ্বর ইত্যাদি কমায়। পালং শাক অ্যাজমা রোগীদের জন্য অনেক উপকারী। পালং শাকে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন -এ, বি, সি, ই, প্রোটিন, অ্যামাইনো অ্যাসিড ইত্যাদি পাওয়া যায়, যা আমাদের দেহের পুষ্টির ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে।
এতে ভরপুর মাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ক্যান্সার প্রতিরোধী গুনাবলি বিদ্যমান।
যাদের ওজন বেশি বা যারা ফিট থাকতে চান, তারা নিয়মিত পালং শাকের জুস খেলে দ্রুত ফলাফল পাবেন। পালং শাকের এসব গুনাবলি আপনাকে শীতে সুস্থ থাকতে সাহায্য করবে। তাই শীতে সুস্থ থাকতে নিয়মিত পালং শাক খান।
০২। গাজর
সালাদ ও তরকারি কিংবা কাঁচা অবস্থায় আমরা গাজর খেয়ে থাকি। গাজর খাদ্যআঁশ সমৃদ্ধ সুস্বাদু একটি সবজি। যদিও সারাবছরই এটি পাওয়া যায়, তবুও শীতকালে একটু বেশি’ই পাওয়া যায়। কারণ এটি একটি শীতকালীন সবজি।
গাজর নানারকম পুষ্টিগুনে ভরপুর। এতে রয়েছে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-বি২, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-কে, বিটাক্যারোটিন, লৌহ, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি। গাজরে থাকা বিটাক্যারোটিন ভিটামিন-এ তে রুপান্তরিত হয়ে আমাদের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে।
এতে থাকা আলফা ক্যারোটিন ও লুটিন নামক উপাদান, যা হৃদরোগ প্রতিরোধ করে। এটি শ্বাসনালির প্রদাহ নিরাময় করে। দাঁত ও মাড়ি ভালো রাখে।
গর্ভাবস্থায় গাজর খেলে শিশুর জন্ডিস হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। গাজরের স্যুপ ডায়রিয়া নিরাময় করে। এছাড়াও গাজর ও রসুনের স্যুপ খেলে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
গাজরে থাকা ক্যারোটিনয়েড ত্বকের কোষ পরিষ্কার করে ত্বকের লাবণ্যতা ফিরিয়ে আনে। রোদে পোড়াভাব দূর করে। শীতে খসখসে হয়ে যাওয়া ত্বককে করে তোলে মসৃণ।
এছাড়াও শীতকালে যাদের ত্বক অনেক বেশি শুষ্ক হয়ে যায় এবং ত্বকের জেল্লা হারিয়ে যায়, তারা যদি খানিকটা কাঁচা দুধ, হলুদ, গাজর ও মধু মিক্স করে মুখে লাগান তাহলে শুষ্কতা দূর হওয়ার পাশাপাশি ত্বক হয়ে উঠবে উজ্জ্বল ও মসৃণ।
আরও পড়ুন-
- কালোজিরা খাওয়ার ১৫টি উপকারিতা
- স্বাস্থ্য ও ত্বক ভালো রাখতে পেঁপের ব্যবহার
- দৃষ্টিশক্তি বাড়ানোর ক্ষেত্রে কার্যকর ১০টি খাবার ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস
০৩। ভিটামিন-সি জাতীয় ফল
ভিটামিন-সি, শরীরে ফাইবারের (আঁশ) ঘাটতি মেটায়। বাইরে থেকে যত্নের পাশাপাশি শীতে সুস্থ থাকতে ভিতরের যত্নটাও অনেক জরুরী। ভিটামিন-সি আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে আপনাকে রাখবে ভিতর থেকে সুস্থ ও এনার্জেটিক।
শীতের রুক্ষ ও খসখসে ত্বকের জন্য ভিটামিন-সি খুবই উপকারী। শীতে ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ কিছু ফল সহজেই পাওয়া যায়। যেমনঃ আমলকি, কমলা, জলপাই, বরই।
নিচে এই ফলগুলোর গুণাবলি তুলে ধরা হলো-
১. আমলকিতে ভরপুর ভিটামিন-সি রয়েছে যা আপনার চুল, ত্বক ও দাঁতকে ভালো রাখবে ও অরুচিভাব দূর করবে। এছাড়াও এটি রক্তস্বল্পতা, বমিভাব, অম্ল, মাথাব্যথা ইত্যাদিও দূর করে থাকে।
২. কমলায় আছে বিটাক্যারোটিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও প্রচুর পরিমানে ভিটামিন-সি ও ক্যালসিয়াম। এটি জ্বর, সর্দি, কাশি, মুখের ঘা, রক্তশূন্যতা ইত্যাদি কমায় ও হজমশক্তি বৃদ্ধি করে।
৩. জলপাইয়ে আছে লৌহ, ভিটামিন-সি এবং ভিটামিন-ই; যা বাতের ব্যথা, হাঁপানি, হৃদরোগ, কোলন ক্যান্সার ইত্যাদি রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।
অলিভ অয়েল বা জলপাই তেল ত্বক ও হৃদপিণ্ডের জন্য খুবই উপকারী। শীতের বাজারে জলপাই অনেক কম দামে পাওয়া যায়। তাই এই সুযোগ হাতছাড়া না করে প্রচুর জলপাই খান কাঁচা অথবা চাটনি বানিয়ে।
এছাড়াও কম দামে জলপাই কিনে নিজেই ঘরে বসে টিউটোরিয়াল দেখে বানিয়ে নিতে পারেন জলপাই তেল বা অলিভ অয়েল।
৪. বরই খেতে আমরা সবাই কমবেশি পছন্দ করি। এতে রয়েছে নানা রোগের প্রতিষেধক। বরইয়ে রয়েছে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম।
বাতের ব্যথা, ফ্লু, হাঁপানি ও কোলন ক্যান্সার ইত্যাদি রোগে বরই খেলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। এছাড়াও এটি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাডায়। তবে পাকা বরইয়ে গ্লুকোজ থাকায় ডায়বেটিস রোগীদের পাকা না খাওয়াই ভালো।
০৩। ব্রকলি
ব্রকলির পুষ্টিগুনের কারণে একে সুপারফুডও বলা হয়। শীতের বাজারে খুব সহজেই ব্রকলি পাওয়া যায়। শীত মৌসুমে নিয়মিত ব্রকলি খেলে নানাবিধ রোগের প্রতিকার মিলবে।
ফুলকপি, বাঁধাকপির মতো ব্রকলিতে থাকা পুষ্টিগুনও ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। এটি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে।
এটি জরায়ু ও স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। ব্রকলিতে আছে দ্রবনীয় ফাইবার; যা আমাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এতে থাকা ফ্যাটি অ্যাসিড ও ওমেগা থ্রি অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি হিসেবে কাজ করে, যা আমাদের অ্যালার্জি ও প্রদাহ কমায়।
এতে রয়েছে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন, কপার, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসয়াম যা আমাদের হাড় ও দাঁত শক্ত ও মজবুত রাখে।
ব্রকলিতে রয়েছে ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন, ফাইবার যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এটি দেহের খারাপ কোলেস্টেরল কমায়। হজমশক্তি বৃদ্ধি করে। এবং এতে থাকা ভিটামিন-এ ও ভিটামিন-ই ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে।
০৪। মধু
মধুতে আছে গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, সুক্রোজ, মন্টোজ, অ্যামাইনো অ্যাসিড, এনকাইম, ভিটামিন বি-১, ভিটামিন বি২, ভিটামিন বি-৩, ভিটামিন বি-৫, ভিটামিন বি-৬, জিংক, কপার, আয়োডিন ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান।
গবেষণা মতে জানা গেছে, মধুতে ৪৫ টিরও বেশি পুষ্টিগুন রয়েছে। প্রায় সব রোগের প্রতিকার মেলে মধুতে। সারা বছর মধু খেলে নানাবিধ অসুখ থেকে বাঁচতে পারবেন। এছাড়াও শীতে মধু খেলে বিশেষ উপকার পাওয়া যাবে।
নিচে মধু খাওয়ার উপকারিতাগুলো উল্লেখ করা হলো-
মধু খাওয়ার উপকারিতা
১. মধু আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মধুতে থাকা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদানের কারণে শরীর নানা ধরণের ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।
২. যাদের অনিদ্রার সমস্যা আছে তারা মধু খেলে অনিদ্রার সমস্যা দূর হবে।
৩. শীতকালে নানাধরণের অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। সে সময় এটা ওটা খাবার খাওয়ার ফলে একটু আধটু হজমের সমস্যা হওয়াটাই স্বাভাবিক। এর জন্য বাজার থেকে অ্যাসিডিটির ঔষধ কিনে খেতে হবে না। প্রতিকার মিলবে ঘরে থাকা মধুতে! নিয়মিত মধু খেলে এমনিতেও হজমের সমস্যা হবে না। আর যখন হবে তখন মধু খেলেও বদহজম, গলা বুক জ্বালা ইত্যাদি সমস্যা দূর হবে।
৪. যাদের অরুচির সমস্যা আছে, বিশেষ করে বাচ্চাদের নিয়মিত ৩-৪ ফোটা মধু খাওয়ালে রুচি ফিরে আসবে ও শরীর সুস্থ্য থাকবে।
৫. মধুতে প্রচুর পরিমানে আয়রন রয়েছে। আয়রন দেহে রক্ত উৎপাদনে সাহায্য করে। যাদের রক্তস্বল্পতা রয়েছে তারা নিয়মিত মধু খেলে রক্তস্বল্পতা দূর হবে।
৬. শীতে জ্বর ও সর্দি কাশির সমস্যা অহরহ দেখা যায়। এসময় মধু, লেবু ও আদা দিয়ে চা করে খেলে জ্বর, সর্দি, কাশি সবকিছু থেকেই পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
৭. শীতকালে মুখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া ও ঠোঁট ফাটা একটি সাধারণ চিত্র। যাতে কমবেশি আমাদের সবাইকে ভুগতে হয়। চিন্তার কারণ নেই, নিয়মিত ঠোঁট ও মুখে মধুর প্রলেপ লাগালে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
৮. শীতে আমাদের ত্বকের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়ে থাকে। এ সময় চর্মরোগ অনেক বেশি দেখা দেয়। চর্মরোগ হলে, আক্রান্ত স্থানে নিয়মিত মধু লাগালে ভালো হয়ে যায়। মধুতে থাকা অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান বিভিন্ন ধরনের ছত্রাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ত্বককে দ্রুত সারিয়ে তোলে।
৯. শরীরের ক্ষত, পোড়া বা ঘা সহজে ভালো হতে চায় না শীতকালে। আক্রান্ত স্থানে মধুর প্রলেপ লাগালে মধুর অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুন বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করবে ও দ্রুত পুড়ে যাওয়া বা ক্ষতস্থান ভালো হবে।
১০. শীতকাল তাপমাত্রা কম থাকে। এসময় মধু খেলে অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বজায় থাকবে ও শরীর থাকবে উষ্ণ।
০৫। আদা ও দারুচিনি চা
শীতের সকালে এবং বিকেলে চা না খেলে যেনো কিছু একটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়; তাই না? শীতে আমাদের সবার প্রিয় একটি পানীয় হচ্ছে চা।
কেমন হয়, যদি এই চা কে পুষ্টিগুনে ভরিয়ে তোলা যায়? হ্যাঁ, রান্নাঘরে থাকা আদা ও দারুচিনির কথা বলছি।
আদায় নানাধরনের গুণ রয়েছে। এটি আমাদের সর্দি কাশি থেকে শুরু করে হৃদযন্ত্রের সমস্যায়ও ভীষণ উপকার করে থাকে। এছাড়াও এটি ইনস্ট্যান্ট বদহজম সারাতে সাহায্য করে।
চায়ে বেশি করে আদা ও ২/১ টুকরো লেবু মিশিয়ে পুষ্টিকর আদার চা বানিয়ে নিতে পারেন খুব সহজেই। এটি নিয়মিত পান করলে জ্বর সর্দি কাশি থেকে মুক্তি পাবেন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
নানা পুষ্টিগুনে সমৃদ্ধ অন্যতম স্বাস্থ্যকর একটি মসলা হলো দারুচিনি। এটি আমাদের গ্লুকোজের মাত্রা কমায়। ফলে নিয়ন্ত্রণে থাকে ডায়বেটিস।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতেও দারুচিনির বিশেষ অবদান রয়েছে। দারুচিনিতে আছে আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, ফাইবার, ক্যালসিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি বদহজম, মাথাব্যথা, ও ওজন কমাতে সাহায্য করে।
দারুচিনি সেদ্ধ করে মধু ও লেবুর রস মিশিয়ে খুব সহজেই বানিয়ে ফেলতে পারেন সুগন্ধিযুক্ত পুষ্টিকর একটি পানীয়। এটি পান করলে বিভিন্ন ধরনের রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন।
প্রয়োজন মনে হলে পড়ে দেখতে পারেন-