শহুরে জীবনে প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে কে না পছন্দ করে? এজন্যই বাসা বাড়িতে ছাদ, কৃষিকাজ বা বাগান করার কাজে ব্যবহার করার পদ্ধতি এখন বেশ জনপ্রিয়। আর শীতকালই যখন বাগান করার সবচেয়ে মোক্ষম সময় তখন আর দেরি না করে আসুন এবার জেনে নেওয়া যাক শীতকালীন ফুলের চাষ করার বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে।
আমার আজকের এই লেখাটি থেকে আপনি জানতে পারবেন, শীতকালীন ফুল সংগ্রহ থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির ছাদে ও আঙিনায় ভালো ফুল ফোটানোর হরেক রকমের টিপস। আরো জানতে পারবেন, কিভাবে আপনি চাইলেই ১০০ রকম ফুল দিয়ে ভরে দিতে পারেন আপনার স্বপ্নের ছাদবাগান!
শীত মৌসুমের যত ফুল
প্রকৃতির বিশেষ নিয়মে শীত মৌসুমে খুব ভালো ফুল ফোটে। আর এই মৌসুমের ফুলের সংখ্যা এত বেশি যে আপনি চাইলেই ১০০ রকম বাহারি সব ফুল দিয়ে আপনার বারান্দা, করিডোর, আঙিনা, বাগান সাজিয়ে ফেলতে পারেন খুব সহজেই।
যদিও এসব ফুলের প্রায় সবই বিদেশি। কিন্তু বিদেশি হলেই বা কি! এই বিদেশিনীদের এখন আর পরদেশি ভাবতে ইচ্ছে করে না।
শীতকালীন ফুল শুধু যে সংখ্যায় বেশি তা নয়, রূপ-বৈচিত্র্যের দিক দিয়েও এরা যে কোনো মৌসুমি ফুলের চেয়ে দুই ধাপ এগিয়ে।
শীতকালীন ফুলগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বড় বড় ইনকা গাঁদা, ছোট ছোট চায়না গাঁদা, দেশি গাঁদা, রক্ত গাঁদা, হলুদে লাল মিশানো জাম্বো গাঁদা, রাজ গাঁদা ইত্যাদি।
এছাড়াও রয়েছে দেশি-বিদেশি বেশ কিছু জনপ্রিয় ফুল যেমন, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, প্যানজি, অ্যাজালিয়া, অ্যাস্টার, ডেইজি, কসমস, সিলভিয়া, পপি, এন্টিরিনাম, ন্যাস্টারশিয়াম, সূর্যমুখী, ফ্লক্স, ভারবেনা, কারনেশান,পর্টুলেকা, ক্যালেন্ডুলা, হলিহক, মর্নিং গ্লোরি, সুইট পি, ডায়ান্থাস, জারবেরা, গ্ল্যাডিওলাস প্রভৃতি।
বাসাবাড়ির ভবনের ছাদ, বারান্দা বা সিঁড়িঘরে পোড়ামাটির টবে কাঁচা মাটি রেখে শীতকালীন এসব ফুলের সাথে গোলাপকেও কিন্তু সঙ্গী করতে পারেন।
বারান্দা বা গ্রিলে কিংবা ঝুলানো টবে লাগানোর জন্য ন্যাস্টারশিয়াস, পিটুনিয়া, অ্যাস্টার, ভারবেনা বেশ ভালো। তবে গ্রিলে লতিয়ে দেওয়ার জন্য মর্নিং গ্লোরি, নীলমণি লতা, সুইট পি এবং রেল লতাও কিন্তু বেশ জনপ্রিয়।
আবার মাটির টবে ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, জারবেরা, কারনেশান, ক্যালেন্ডুলা, অ্যাস্টার ইত্যাদি শীতকালীন ফুলের চাষ করতে পারলেও জমিনের বাগানে লাগাতে পারেন সব ধরনের মৌসুমি ফুল।
রোপণ উপযোগী চারা সংগ্রহ
শীত মৌসুম আসলেই ফুলের গাছ ও চারা কেনা বেচার উৎসব শুরু হয়ে যায় সারা দেশ জুড়ে। কাজেই উপরে উল্লেখিত ফুলের চারা গুলো সংগ্রহ করতে আপনাকে খুব বেশি দূরে যেতে হবে না।
যে কোন এগ্রিকালচার ফার্ম কিংবা আপনার এলাকার স্থানীয় নার্সারি গুলোতে খোঁজ নিলেই দেশি বিদেশি নানান ধরণের শীতকালীন ফুলের সন্ধান পাবেন।
কোথায় এবং কিভাবে শীতকালীন ফুলের গাছ লাগাবেন?
শীতকালীন ফুলের চাষ করার জন্য চারা তো সংগ্রহ করলেন, এখন ঠিক করে নিন কোথায় আর কীভাবে সেগুলো লাগাবেন।
বাসাবাড়ির আশে পাশে বা আঙিনায় ফাঁকা জমি না থাকলে মন খারাপ করার কোন প্রয়োজন নেই, কেননা মাটির টবেই করতে পারবেন শীতকালীন যে কোন ফুলের চাষ।
স্থায়ী বাগান করার চেয়ে মাটির টবে শীতকালীন ফুলের চাষ করাই যেন বেশি সুবিধে। কারন, ইচ্ছেমতো টব সাজিয়ে বাসাবাড়ির যেকোনো জায়গায় টুকরো টুকরো বাগান করে নেওয়া যায় খুব সহজেই ।
আজ যেখানে গাঁদার বাগান করেছেন, কালই সেখানে দশটা টব সাজিয়ে করে ফেলুন ন্যাস্টারশিয়ামের বাগান, পরশু করুন ক্যালেন্ডুলার। এই বৈচিত্র্য কি আপনি ইচ্ছে করলেই জমিনে আনতে পারবেন?
ছাদ থাকলে সেখানে টবে নানান ধরনণের শীতকালীন ফুলের চাষ করে আপনিও আপনার বাড়িতে একটি ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান গড়ে তুলতে পারবেন খুব সহজেই।
শীতকালীন ফুলের চাষ করার জন্য আপনাকে যা করতে হবে তা হল, টব সংগ্রহ, উপযুক্ত মাটি সংগ্রহ , সঠিক ভাবে চারা রোপণ আর নিয়মিত পরিচর্যা।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়তে থাকুন।
টব সংগ্রহের নিয়ম
মনে রাখবেন, এই শীত মৌসুমে বাসাবাড়িতে ফুলের চাষ করার প্রথম ধাপটি হল উপযুক্ত সাইজের টব সংগ্রহ করা। গাছ অনুযায়ী টব সংগ্রহ করতে হবে। বড় গাছের জন্য ছোট টব কিন্তু চলবে না। তবে ছোট গাছের জন্য বড় টব হলে ক্ষতি নেই।
শীতকালীন ফুলের চাষ করার জন্য মাটির টব বেশি ব্যাবহার করা হলেও, প্লাস্টিকের টব হালকা হওয়ায় অনেকেই এটাকে ঝোলানো টব হিসেবে ব্যবহার করে।
তা সেটা যে টবই হোক, শীত মৌসুমে ফুলের চাষ করার জন্য চারা রোপণের আগে টবটা পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলুন। এরপর কড়া রোদে ভালো করে শুকিয়ে নিলে এতে ব্যাকটিরিয়া, ছত্রাক বা পোকার আক্রমণ অনেকটাই কম হবে।
খেয়াল রাখবেন, অবশ্যই টবের নিচে ১/২ টি ছিদ্র থাকতে হবে। যাতে অপ্রয়োজনীয় পানি চুইয়ে পড়তে পারে।
শীতকালীন ফুল চাষ করার জন্য প্রতিটি ছিদ্রযুক্ত টবের নিচে ভাঙ্গা চাড়া, নারিকেলের ছোবড়া, খড়কুটা বা ইটের টুকরো দিয়ে বন্ধ করে তার উপর কিছু শুকনো পাতা দিয়ে ঢেকে তারপর টবে মাটি রেখে দিলেই চারা রোপণের জন্য আপনার টবটি প্রস্তুত হয়ে যাবে।
উপযুক্ত মাটি সংগ্রহ ও প্রস্তুতকরণ
বাসাবাড়ির বাগানে বা টবে শীতকালীন ফুলের গাছ থেকে বেশি ফুল পেতে আপনাকে অবশ্যই মাটির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। মাটির পিএইচ এর সঠিক মাত্রা আর উর্বরতা শীত মৌসুমের ফুল গাছের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণভাবে শীতকালীন ফুল চাষের জন্য উপযুক্ত মাটি বলতে দোঁআশ মাটিকেই বোঝায়। আর, এই মাটি সংগ্রহের আদর্শ জায়গা হচ্ছে অনাবাদি মাঠ , ক্ষেতের মাটি, পুকুর ও নদীর পাড়।
মনে রাখবেন, সর্বদাই মাটি নিতে হবে উপর থেকে দেড় ফুট গভীরতা পর্যন্ত। কারন, গভীর গর্তের মাটি, পাতকুয়া খোড়া মাটি, পুকুরের তলার পাঁকমাটি, চারা রোপণের জন্য ভাল নয়। কারণ বেশি নিচের মাটি প্রকৃতিতে কঠিন ও গুণে অসার হয়।
এখন,সংগৃহীত মাটিকে ভাল করে রোদে শুকিয়ে নিন। তারপর, দশ ইঞ্চি মাপের প্রায় ১০০ টব মাটির সঙ্গে ৫০০ গ্রাম গুঁড়ো চুন মিশিয়ে দশ দিন বাদে চার ভাগের এক ভাগ গোবর সার, পাতা পচা সার বা কম্পোস্ট সারের যে কোনও একটি ও পাঁচ কেজি হাড়ের গুঁড়ো, পাঁচ কেজি শিং-এর গুঁড়ো, এক টব মতো কাঠ ও ঘুঁটে পোড়া ছাই মিশিয়ে দু‘ মাসের বেশি সময় কোন উম্মুক্ত স্থানে রেখেদিন।
চারা রোপণের সঠিক পদ্ধতি
মাটি প্রস্তুত হয়ে গেলে এবারে চারা রোপণের পালা। রোপণের সময় চারাগাছের শিকড় চারদিকে প্রসারিত করে আলতোভাবে টব ভর্তি করে দিতে হবে।
এরপর আস্তে আস্তে চাপ দিয়ে মাটি শক্ত করে দিতে হবে, যেন চারাগাছ হেলে না পড়ে বরং সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
সদ্য রোপণ করা এই শীতকালীন ফুলের চারা গুলো কয়েকদিন ছায়া তে রেখে সহনশীল করে নিতে হবে। সেটা যদি সম্ভব না হয় তাহলে কলা বা সুপারী গাছের খোল কেটে অথবা অন্য কোন উপায়ে চারাগুলো রৌদ্র থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
কিন্তু চারা গুলোকে সকালে-বিকালের রোদ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে ভুলবেন না যেন!
ফুল গাছের পরিচর্যা
টবের মাটির গুনাগুন ও খাদ্যোপাদান সীমিত হওয়ায় টবে লাগানো গাছের পরিচর্যা করতে হয় একটু বেশি। আর শীত মৌসুমে যখন বাতাসের আদ্রতা কম থাকে তখন এই পরিচর্যার চাহিদা বেড়ে যায় আরো খানিকটা।
শীতকালীন ফুলের গাছ লাগানোর পর থেকে খৈল,মাছ গোবর ইত্যাদি মেশানো আধা লিটার পচা পানি চার লিটার বিশুদ্ধ মিঠা পানির সাথে মিশিয়ে প্রতিটি গাছে আধা লিটার করে প্রতি সপ্তাহে একবার করে দিতে হবে।
মনে রাখবেন, যেকন তরল সার ব্যবহারের সময় গাছের গোড়ার মাটি বেশ ভেজা ভেজা থাকা দরকার। তাই এরকম তরল সার ব্যবহারের কয়েক ঘন্টা আগে গাছে একবার সেচ দিয়ে নিতে হবে। তরল সার দেয়ার পরও একবার সেচ দিলে বেশ ভাল হয়।
শীতে ভালো ফুল ফোটানোর বিশেষ কিছু টিপস
শীতকালে ফুল ফোটে ভালো, তবে বাসাবারড়ির ছাদে মাটির টবে করে কৃত্রিম ভাবে এই আদ্র মৌসুমের ফুলের চাষ করা কিন্তু বেশ শক্ত ব্যাপার।
এক্ষেত্রে নিচের টিপস গুলো মেনে চললে বেশ উপকৃত হবেন-
- শীত মৌসুমের ফুল গাছ গুলো বাসাবারড়ির আঙিনা বা ছাদের রোদেলা জায়গায় লাগানো উচিত।
- গাছের চেহারা যদি দুর্বল দেখা যায়, তাহলে আর দুঃচিন্তা না করে, পরপর তিন-চার দিন এক লিটার পানির মধ্যে দুই চা চামচ ইউরিয়া সার গুলে ঝাঁজরি দিয়ে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত হালকা বৃষ্টির মতো গাছ-পাতা ভিজিয়ে দিলেই শীত মৌসুমের ফুলের গাছ গুলো বেশ সতেজ থাকবে।
- শীত মৌসুমের ফুল গাছ গুলোতে কুঁড়ি না আসা পর্যন্ত, সরিষার খইল কয়েক দিন একটি পাত্রে ভিজিয়ে রেখে তা গুলে ১৫ দিন পরপর গাছের গোড়ার চারদিকে দিন। এতে ফুল বেশি ফুটবে।
- প্রতি ১০-১৫ দিন পরপর গাছের গোড়ার মাটি ৩-১০ সেঃ মিঃ বা ১ থেকে ৪ ইঞ্চি গভীর করে হালকা নিড়িয়ে দিন।
- শীতকালীন ফুলের গাছ গুলো আরো বেশি সতেজ রাখতে চাইলে, গাছে পানি দেওয়ার সময় শুধু গাছের গোড়ায় পানি না দিয়ে, ঝাঁজরি দিয়ে নিয়মিত গাছের ওপর থেকে হালকা বৃষ্টির মতো গাছ-পাতা ভিজিয়ে পানি দিন।
- গাছে ফুল ফোটা শুরু হলে ফুল-পাতা ভিজিয়ে পানি না দেওয়াই ভালো।
- যদি স্বাভাবিক সময়ের আগে গাছে কুঁড়ি আশে, তাহলে সেটি ভেঙে দিন।
- গাছের গোড়া যদি ভেজা থাকে তাহলে কিন্তু পানি দেওয়া যাবে না।
- শীতকালীন ফুল শুকাতে শুরু করলে খুব দ্রুত তা গাছ থেকে কেটে ফেলুন।
- শীতকালীন প্যানজি গাছের বয়স হলে কিন্তু ফুল ছোট হয়ে আসবে। সে ক্ষেত্রে গোড়া
থেকে ছেঁটে দিলে নতুন গজানো ডালে আবার ভালো ফুল ফুটতে শুরু করবে । - অ্যান্টিরিনামের ভালো ফুল পেতে চাইলে শুধু মাঝের ডালটি রেখে অন্য সব ডাল কচি
অবস্থাতেই ছেঁটে ফেলুন। - টবের মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য কেঁচো সার বা গোবর ও শুকনা পাতার মিশ্রণ মাটিতে মিশিয়ে দিন। এতে শীতকালীন ফুলের চাষ খুব ভালো হয়।
- দুই লিটার পানিতে দুই ফোটা লিকুইড সাবান মিশিয়ে সেই মিশ্রণ দিয়ে মাঝে মাঝে পাতাগুলো ধুয়ে দিন। নিয়মিত এটি করলে মিলিবাগ থেকে শুরু করে গাছের যত রকমের রোগবালাই হয় তার একটিও আর হবে না।
- শীতকালীন যেকন ফুলের আকার যদি বড় করতে চান, তাহলে প্রথম কুঁড়িগুলো নখ দিয়ে খুঁটে ভেঙে দিতে হবে । এতে তুলনামূলক ভাবে ফুলের আঁকার কিছুটা বড় হবে।
শেষ কথা
ফুল নিতান্তই শখের জিনিস হলেও,শীতকালীন ফুল চাষ করে স্বচ্ছলতার মুখ দেখছে অনেকেই। কেননা, আজকাল বিদেশেও ফুল রপ্তানি হচ্ছে। যা থেকে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর একটি হিসাবে দেখা যায়, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এদেশ থেকে ফুল রপ্তানি হয়েছিল ২৭৬ কোটি ৯ লাখ টাকার, ২০০৯-২০১০ সালে ৩২৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা এবং ২০১০-২০১১ সালে ৩৬২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার। আর প্রতিবছরই এই রপ্তানি আয় বেড়েই চলেছে।
রকমভেদে এই ফুলের গাছগুলো অক্টোবর থেকে প্রায় মার্চ মাস পর্যন্ত ফুল দেয়। তাই এখনই উপযুক্ত সময় শীতকালীন ফুল চাষ করে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার।
প্রাসঙ্গিক লেখা সমূহ-