একজন মানুষের হাতেখড়ি ঘটে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই। এখান থেকেই একটি শিশু নৈতিকতাবোধ শিক্ষা পেতে শুরু করে। কোনটা ঠিক, কেনটা ভুল বুঝতে পারে। একটি জাতির মেধা-মনন ও সভ্য জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে প্রাথমিক শিক্ষার ভূমিকাই বেশি। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উন্নত রাষ্ট্রগুলোর অগ্রগতির পিছনে উন্নত ও যুগোপযোগী শিক্ষা গ্রহণই মূল কারণ।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রাথমিকে ভর্তির হার ৯৮ শতাংশ হলেও মাত্র ৬৭ শতাংশ বা তার চেয়ে কম হারে শিক্ষার্থী মাধ্যমিক উত্তীর্ণের যোগ্যতা অর্জন করে।
আর উচ্চ শিক্ষায় পৌঁছায় মাত্র ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী। স্কুলে যাওয়ার উপযুক্ত প্রায় ৬২ লাখ শিশু এখনও শিক্ষার বাইরে রয়ে গেছে। তাদের বেশীর ভাগের বাস শহরের বস্তি বা দুর্গম অঞ্চলে।
এদের মধ্যে ৪৬ লাখ শিশুই প্রাথমিক স্কুলে যাওয়ার বয়সী।
শিক্ষা খাতও রক্ষা পায়নি দুর্নীতির কালো হাত থেকে। দুর্নীতি এই খাতের উন্নতির একটি বড় অন্তরায়। তাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমরা যেভাবে খুব উন্নত বলে ভাবি তার থেকেও কয়েকগুণ বেশি পিছিয়ে।
যার কারণ হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকেও আমরা দায়ী করতে পারি৷
খোঁজ নিলে দেখা যাবে, প্রাইমারি স্কুল বা কেজি স্কুল সমূহে যারা শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত তাঁদের অধিকাংশই এই পেশার যোগ্য নয়। গুণগত মানসম্মত ও সঠিক শিক্ষা প্রদান করতে হলে যোগ্য ও মেধাবীদের প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে হবে।
কিন্তু যারা শিক্ষকতায় আসছেন তাদের একটি বড় অংশই আসে অনৈতিক মাধ্যমে। ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পান বেশিরভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।
যখন আমরা কেজি স্কুলে পড়েছি, লক্ষ্য করেছি- তার মধ্যে বেশিরভাগ শিক্ষকরাই ইংরেজিতে দূর্বল থাকতো। শব্দ উচ্চারণ ভুল বলতেও শুনেছি আমরা অনেকেই। সেটাই আমরা হা হয়ে গিলেছি । এখনও এমনটা অনেক জায়গায়ই ঘটে।
এইসব বন্ধ করার পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পূর্ণ ভিন্ন ও প্রাপ্য বেতন কাঠামোর ব্যবস্থা করতে হবে।
তাছাড়া দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ব্যবহার করা হচ্ছে সরকারি অন্য সব কাজে। যেমনঃ ভোটার তালিকা তৈরির কাজ। এসব কাজ শিক্ষকদের না দিয়ে নির্দিষ্ট প্রকল্পের জনগনকে জড়িত করা প্রয়োজন কিংবা নিয়োগ দেওয়া দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একজন ছাত্রকে পড়ানো যতটা সহজ, ঠিক ততটাই কঠিন প্রাথমিকের বাচ্চাদের পড়ানো। সেই দিক থেকে উনাদের সম্মানীর পরিমাণটা দুঃখজনকই।
কেনো এমন চিন্তা ভাবনা? প্রশ্নটা থেকেই যায়।
সরকার নির্ণয় করে দিক- প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আবেদনকৃতদের শিক্ষাগত যোগ্যতার মানদণ্ড কি হওয়া উচিত।
প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো উন্নত ও গুণগত মানসম্মত করা এখন সময়ের দাবী। কারণ এর প্রভাব গিয়ে পড়বে মাধ্যমিকে।
এটা ঠিক চেইন প্রক্রিয়ার মত। শুরুটা সঠিক থাকলে, পরের ধাপটিই সুন্দর ভাবে পার হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ভিত্তিটাও গড়ে উঠে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর থেকে। প্রতিটি শিশুরই প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করা প্রয়োজন। এখান থেকেই তৈরি হয় মানুষের মত মানুষ হবার দক্ষতা।
শিশুদের পড়ানোর মাঝে মুখস্থ বিদ্যাটা না এনে আনতে হবে জানাবার, বোঝাবার সক্ষমতা। শিশুদের মাঝে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রয়াস তৈরি করতে হবে।
একটি ৭বছরের বাচ্চার বই সংখ্যা ৫-৬টি কেন হবে? বরং তাকে তৈরি করতে হবে পরের ধাপের জন্য।
বাচ্চাদের জন্য পড়াটা হতে হবে আনন্দের। তার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়গামী শিশুদের কোচিং এ যাওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।
মূলত প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারলে ভবিষ্যতের শিক্ষার মান আরও উন্নত হবে। এ কারণে প্রাথমিক শিক্ষা সকল শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।
সুযোগ করে দিতে হবে দরিদ্র শিশুদের। সরকারের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে প্রাথমিক স্তরের বাচ্চাদের প্রতি।
গ্রামাঞ্চলে এখনও অনেক অভিভাবকদের মধ্যে শিক্ষা নিয়ে ভুল ধারণা আছে। এদিকেও নজর দিতে হবে।
যেহেতু শিক্ষার বেশিরভাগ অংশই শিক্ষকদের হাতে সুতরাং শিক্ষকদেরই তাঁদের পেশার প্রতি মন থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
পাশাপাশি শিশুদের মাঝে মানবিক গুণাবলি ছড়িয়ে দিতে হবে। কারণ শিক্ষার উন্নতির সিঁড়ি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা।
প্রাসঙ্গিক লেখা-