উত্তেজিত মানসিক অবস্থাকে ক্রোধ বা রাগ বলে। রাগের সময় কারোরই হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। অত্যাধিক রাগের ফলে হার্ট ফেইলুর, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক ইত্যাদি হওয়ার আশংকা অনেক বেড়ে যায়। রাগের সময় মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বুদ্ধি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমনকি রাগের বশে খুনও করে ফেলে অনেকে। এই ভয়ংকর ব্যাধির ফলে সামাজিক, ব্যাক্তিগত ও কর্মজীবনের উপর নেতিবাচক প্রভাব পরে।
রাগ ব্যাক্তিকে অপছন্দের পাত্র বানিয়ে ফেলে সবার কাছে। ক্ষনিকের রাগের জন্য মানুষের মনে নেতিবাচক ভাবনা সৃষ্টি করা বোকামি ছাড়া কিছুই না। রাগ দূর করার জন্য অনেকে অনেক কিছুই করে থাকে। অনেক সময় সেগুলো ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে না। আবার অনেকে কঠিনভাবে নিয়মকানুন মেনে চলতে পারে না।
সকল দিক বিবেচনা করে আজকের আলোচনায় থাকছে রাগ নিয়ন্ত্রণের ৬টি সহজ কৌশল।
১। শান্ত থাকুন
রাগের সময় মানুষ অশান্ত হয়ে যায়। যা বলা অনুচিত সে কথাও বলে ফেলে তখন। কিন্তু রাগ কমার পর বুঝতে পারে কি ভুলটাই না তার দ্বারা হয়ে গেছে। রাগ এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যা ব্যক্তিকে বেপরোয়া মনোভাব সমপন্ন করে ফেলে। সে কোনো কিছুর পরোয়া না করে অনুচিত, অশ্রাব্য কথা বলে ফেলে। চিৎকার করে বা ভাঙ্গচুর করে। এবং পরবর্তীতে আফসোসের সীমা থাকে না।
যখন আপনি বুঝবেন আপনি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছেন অর্থাৎ রেগে যাচ্ছেন তখনই ৫০ থেকে উলটো গুনতে শুরু করবেন। যেমনঃ- ৫০, ৪৯, ৪৮, ৪৭, ৪৬, ৪৫, ৪৪…………………।
এভাবে উল্টো দিক থেকে গুনে গুনে ১ পর্যন্ত আসবেন।
২ বার এই ট্রিকসটি করলেই আপনার সম্পূর্ণ রাগ কর্পুরের মতো উড়ে যাবে। বিজ্ঞান বলে, রাগের সময় মানব মস্তিষ্ক অনেক বেশি উত্তেজিত হয়। ঠিক এই সময় যদি ৩০ – ৬০ সেকেন্ড তাকে নীরব রাখা যায়, শান্ত রাখা যায়; তাহলে রাগ কমতে থাকে। আর এর জন্য দরকার মনকে অন্য কোনো কিছুতে ব্যস্ত রাখা।
গননা করার বিষয়টি অনেক বেশি জনপ্রিয়। আমরা সবসময় ক্রমানুসারে গননা শুরু করি। এর ব্যতিক্রম ঘটলে ভেবে চিনতে গুনতে বিরতি নিতে হয়। তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখার এটা সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি।
২। সতেজ হোন
সতেজ ও ঝরঝরে হওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে গোসল করা। ক্রোধ বা রাগের পর শরীরটা কেমন ভারী ভারী লাগে না? সকল কিছুর প্রতি বিরক্তি বোধ কাজ করে না? হ্যাঁ, তখন ভালো ভালো বিষয় বস্তু বা কেউ ভালো কথা বললেও কেমন যেনো অন্যরকম লাগে। নিজেকে কেমন যেনো অসহায় লাগে। ক্লান্তি অনুভব হয়। দুঃখ, হতাশা কাজ করে।
তাই, এসব ক্লান্তি গ্লানি দূর করতে চট করে গোসল করে নিন। মাথায় কিছুক্ষন ঠান্ডা পানি ঢালুন। গোসল করার সময় আপনি চিন্তা করার যথেষ্ঠ সময় পাবেন। কেউ বিরক্ত করবে না। কোনো হঁইচই থাকবে না।
নিজের সমস্ত রাগ, দুঃখ, খারাপ লাগা গোসলের পানির সাথে ভাসিয়ে দিন। শরীরটা ঝরঝরে ও সতেজ হয়ে যাবে। পরপরই সাত-পাঁচ না ভেবে একা হাঁটতে বেরিয়ে পরুন। প্রকৃতিকে দেখুন।
নিজেকে নিয়ে ভাবুন। কতোটা ভাগ্যবান আপনি! কতো মানুষ আছে চোখে দেখতে পায় না, হাঁটতে পারে না, কথা বলতে পারে না, কানে শুনতে পায় না। ক্ষনিকের খারাপ পরিস্থিতির জন্য রাগ করে দুঃখ না পেয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রাণভরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। পারলে কিছু গরীব অসহায়দের সাহায্য করুন। মন এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে।
৩। গান শুনুন
গানের কতোই না প্রকারভেদ আছে। কষ্টের গান, সুখের গান, প্রেমের গান, বিরহের গান, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছু কিছু গান আমাদের অনুভূতির সাথে মিলে যায়। আর সেগুলোই আমাদের পছন্দের গান। পছন্দের গান আমাদেরকে প্রশান্তি দেয়। তাই গান শোনার উপদেশ দেন অনেকেই। গান আমাদেরকে আশেপাশের পরিবেশ ভুলতে সাহায্য করে। অন্যদিকে মনোনিবেশ করায়। গান শুনলে মস্তিষ্ক শান্ত হয়। তাই রাগ উঠলে তৎক্ষনাৎ কানে এয়ারফোন গুজে পছন্দের গান শুনুন।
রাগের সময় চেষ্টা করবেন সফট বিটের গান বেশি শুনতে। চারপাশের সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গানে মনোযোগ দিন। চাইলে গুনগুন করে নিজেও গাইতে পারেন।
৪। লিখুন
রাগের সময় আমরা নিজের কথাটা বলার জন্য ছটফট করি। অপরপক্ষও নিজের কথা বলতে চায় তখন। ঠিক তখনই শুরু হয়ে যায় দন্দ্ব। তাই রাগের সময় চুপ থাকুন। সম্ভব হলে সে জায়গা ত্যাগ করুন। এবং একটা শান্ত শিষ্ট জায়গায় বসে পরুন। ডায়েরি সবসময় হাতের কাছে থাকে না। সেক্ষেত্রে ফোনের নোটপ্যাডে আপনার মন উজার করে লিখুন। ব্যক্ত, অব্যক্ত যতো কথা আছে সব লিখুন। কেমন অনুভব করছেন, কিভাবে কি হতে পারতো, কোন কাজটা করা ঠিক হয়নি, কোন কাজটা অন্যভাবে করা যেতো- শান্ত মনে এইসব নিয়ে ভাবুন এবং লিখে ফেলুন।
৫। মেডিটেশন করুন
মেডিটেশন আমাদের মনোসংযোগ বৃদ্ধি করে। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় মনকে কেন্দ্রীভুত করে। মেডিটেশন করার ফলে হতাশ হওয়ার সম্ভবনা বহুলাংশে কমে যায়। একাকি জীবনের বিরক্তিবোধ, নানা রকমের চিন্তা-ভাবনা, জীবনের অনেক চাওয়া, না পাওয়া ইত্যাদির ফলে খারাপ লাগা কাজ করে। কোনো কিছুতেই মন বসে না। মন কেমন যেনো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
ভেতরের কষ্টটাকে কিছু সময়ের জন্য দূর করতে মানুষ ক্রুদ্ধ হয়। অন্য কারো উপর সে রাগ ঝাড়তে চায়। রাগের বশে অনেক অঘটন ঘটে যায়। যা পরবর্তীতে আমাদের অনুশোচনায় দগ্ধ করে। রাগ, হতাশা, ইত্যাদি দূর করতে চাইলে মেডিটেশন করুন নিয়মিত। মেডিটেশন আমাদের একাকিত্ব ও দুঃশ্চিন্তা দূর করে, আত্নবিশ্বাসী করে তোলে। তথ্য ধারণক্ষমতা বাড়ায়। অর্থাৎ, আমাদের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে।
মনকে শান্ত ও চিন্তামুক্ত রাখতে প্রত্যেকেরই মেডিটেশন করা উচিত। বিশেষ করে যারা একটুতেই রেগে যান, মেডিটেশন তাদের জন্য ঔষধের মতো কাজ করে। যাদের রাগ বেশি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে অবশ্যই তারা দিনে একবার মেডিটেশন করবেন।
যেভাবে মেডিটেশন করবেন –
১। ভোরে মেডিটেশন সবচেয়ে ফলপ্রসূ। এই সময় চারিদিক কোলাহল মুক্ত থাকে। সতেজ হাওয়া গায়ে লাগে। প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়। তাই চেষ্টা করুন ভোরে মেডিটেশন করতে।
২। মেডিটেশনের জন্য খোলামেলা ফাঁকা জায়গা বেছে নিন।
৩। পাতলা, পরিচ্ছিন্ন জামা পরিধান করুন।
৪। আরাম করে, চোখ বন্ধ করে বসুন।
৫। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। কিছু সময়ের জন্য সকল চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। যে কোনো এক বিন্দুতে মনোনিবেশ করুন।
৬। জোরে জোরে শ্বাস নিন, প্রশ্বাস ছাড়ুন। কিভাবে বাতাস ভেতরে ঢুকছে, কিভাবে বের হচ্ছে সেগুলো নিয়ে ভাবুন।
৭। আপনার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভাবুন। জীবনে কি চান, সেটা পেতে হলে কি কি করতে হবে; সেগুলো নিয়ে ভাবুন।
৮। চোখ বন্ধ করে স্থির হয়ে বসে থাকুন ১৫-২০ মিনিট।
৬। নিজের যত্ন নিন
কর্মময় ব্যস্ত জীবনে নিজেকে নিয়ে ভাবার সময়টুকু যেনো হয়ে ওঠে না অনেকের। প্রতিদিনের বোরিং কাজ একঘেয়ে করে তোলে। এর ফলে রাগান্বিত হওয়াটা স্বাভাবিক। সকল কাজ ও ব্যস্ততার উদ্দেশ্য একটাই। তা হলো সুখী হওয়া, দিন শেষে একটু ভালো থাকা। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কাজ ও ব্যস্ততাকে এতো বেশি প্রাধান্য দেন যে, তারা জীবনের আসল উদ্দেশ্যে থেকে দূরে সরে যান। কাজের পেঁছনে এতো বেশি ছুটোছুটি করেন যে নিজের জন্য একটু সময় বের করতে পারেন না।
হতাশা, রাগ তাদের গ্রাস করবে এটাই স্বাভাবিক। চিন্তামুক্ত, রাগমুক্ত, ফুরফুরে মেজাজের থাকতে হলে নিজের যত্ন নেওয়া অনেক বেশি জরুরী। তাই সবার আগে নিজের প্রতি যত্নশীল হোন। সময়মতো খাবার খান, সময়মতো ঘুমোতে যান। পরিবারের সাথে বেশি বেশি সময় কাটান, তাদের কথা শুনুন বুঝতে চেষ্টা করুন তাদের।
মোটিভেশনাল ভিডিও দেখুন। যা করে আপনি শান্তি পান সেগুলো করুন। আপনার প্রিয় শখগুলো পূরণ করার মিশনে লেগে যান। এসব, রাগ, ক্রোধ এগুলো সাময়িক অবস্থা মাত্র। তাই সাময়িক অবস্থাকে প্রশ্রয় দিয়ে নিজের সুখকে বিসর্জন দিবেন না যেনো! সর্বোপরি নিজে ভালো থাকুন, অপরকে ভালো রাখুন।
প্রয়োজন মনে হলে পড়ে নিতে পারেন-