পৃথিবীর বাইরের মহাশূন্যে সম্পূর্ণ নতুন একটি জাগতিক বিশ্বের আবিষ্কার সকলের মনকে আন্দোলিত করে। প্রতিনিয়ত মহাবিশ্বকে জানার অবিরাম চেষ্টা চলছে। হচ্ছে বিস্তর গবেষণা। আজ মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে যতটুকু সাফল্য অর্জিত হয়েছে তা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া কখনই অর্জন করা সম্ভব হতো না। মহাকাশে মানুষের স্বশারিরীক অভিযান ও রোবটিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে এ বিশ্ব এবং এতে বসবাসকারী লোকজনের জন্য তা বিরাট সুফল বয়ে এনেছে।
৫ জুলাই ১৬৮৭ সালে স্যার আইজ্যাক নিউটন তার “mathematical principle of natural philosophy” গ্রন্থে মহাকাশ তত্ত্বের বর্ণনা করেন। ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়ন স্পুটনিক-১ নামের প্রথম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে। ১৯৫৭ সাল থেকে কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ এবংরোবটিক মহাকাশযানের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা সৌরজগৎ সম্পর্কিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে চলেছেন।
রোবটিক মহাকাশযান চাঁদে, শুক্র গ্রহে, মঙ্গলগ্রহে এবং মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যবর্তী গ্রহাণুপুঞ্জে অবতরণ করে এদের সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের তথ্য সরবরাহ করেছে। তাছাড়া রোবটিক মহাকাশযানের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা হ্যালির ধূমকেতু সহ অন্যান্য ধুমকেতু সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন।
এই তথ্যগুলো ব্যবহার করে ছায়াপথ, নক্ষত্র, গ্রহ এবং অন্যান্য সৃষ্টি তান্ত্রিক বিষয়বস্তুর উৎপত্তি এবং বিবর্তন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান গভীর করে তুলেছে। এই সংক্রান্ত গবেষণায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বর্তমানে রোবট নিয়ন্ত্রিত মহাকাশযান বা ড্রোন ব্যবহার করে মানবকল্যাণে বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। কক্ষপথীয় উপগ্রহগুলি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনেও বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান করে আসছে। যেমন বায়ুমন্ডলে আবহাওয়া সম্বন্ধীয় উপগ্রহগুলো আমাদেরকে আবহাওয়ার বিভিন্ন ধরনের তারতম্য এবং তারতম্যের কারণ সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে।
আবার কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে সংগ্রহীত তথ্য দ্বারা বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ গুলোর ব্যবহার পদ্ধতি উন্নয়ন সাধন করেছেন।
টেলিকমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আমরা মুহুর্তের মধ্যে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে কণ্ঠস্বর, ছবি এবং তথ্য পাঠাতে পারি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার স্যাটেলাইটগুলো যথার্থ নৌবাহ বিজ্ঞান, অবস্থান এবং সময় সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করায় এই স্যাটেলাইটগুলো মানুষের পার্থিব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে কিছু কিছু দেশের মিলিটারি কর্তৃপক্ষের কাছে পৃথিবী পর্যবেক্ষণকারী স্যাটেলাইটগুলো নৌ, বিমান ও সেনা বাহিনীর মতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অন্যতম উপাদান হলো নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা যা মহাকাশ ভ্রমণকে কেন্দ্র করে উন্নত হয়েছে এবং তা মানবকল্যাণে সর্বোচ্চ মাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
মহাকাশে মানুষের যাত্রার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হয় ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল। ঐ দিন সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউরি গ্যাগারিন ভ্রমণ করেন।
মহাকাশ যাত্রায় ইতিহাসে নারীরাও কিন্তু পিছিয়ে নেই। ১৬ জানুয়ারি ১৯৬৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম মহিলা নভোযাত্রী ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা ৪৮ বার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেন।
১৯৬৬ সালে জেমিনি-৮, ১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই অ্যাপোলো-১১ নামের নভোযানের চন্দ্র অভিযান, ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই নীল আমস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স ও এডুইন অল্ড্রিন জুনিয়র চাঁদে অবতরণ করেন এবং নীল আমস্ট্রং, এড্রুইন অল্ডিন জুনিয়র চাঁদের বুকে প্রথম পা রাখেন।
এরপর ১৯৭০ সালে ভেনেরা-৭ শুক্র গ্রহে অবতরণ করে সরাসরি সেখান থেকে ২৩ মিনিট যাবৎ পৃথিবীতে তথ্য প্রেরণ করেন। ১৯৭১ সালে মার্স-৩ মিশনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম মঙ্গল গ্রহ থেকে সরাসরি পৃথিবীতে ২০ সেকেন্ড যাবৎ তথ্য পাঠানো হয়। পরবর্তীতে অন্য গ্রহ থেকে পৃথিবীতে তথ্য প্রেরণের ওই ব্যাপ্তিকাল আরো দীর্ঘায়িত হয়।
মানুষের পাশাপাশি ১৯৯৭ সালের ৪ জুলাই ২২ পাউন্ড ওজনের সোজার্নার নামক প্রথম রোবটটি পাথফাইন্ডার নভোযানের মাধ্যমে মঙ্গলে প্রেরণ করা হয়।
আবার ২০১২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা (NASA -AERONAUTICS and SPACE ADMINISTRATION) মঙ্গল গ্রহে প্রাণের সন্ধান রোবট যান কিউরিওসিটি রোভার ( Curiosity rover) পাঠায়। এটি মঙ্গল গ্রহে নাসার প্রেরিত চতুর্থ রোবটযান।
গবেষকরা মঙ্গল পৃষ্ঠে প্রাচীন নদীর রেখা, পানি প্রবাহ, পাথর প্রভৃতি সন্ধান পেয়েছেন। এটি এখন পর্যন্ত নাসার বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বড় সাফল্য। রোবট যন্ত্রের ওজন প্রায় ১ টন। এটি ২০১১ সালের নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় কেপ ক্যানাভেরালের থেকে যাত্রা শুরু করে এবং ৫৭ কোটি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মঙ্গলগ্রহে পৌঁছায়।
কিউরিওসিটিতে আছে বিভিন্ন ধরণের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, ক্যামেরা, আর আবহাওয়া কেন্দ্র। রোভার যানটির আছে একটি শক্তিশালী রোবটিক হাত, দূর থেকে পাথর চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে পারা লেজার, একটি রাসায়নিক গবেষণাগার। আর বিকিরণ মাপার ডিটেক্টর।
মহাশূন্যে সফলভাবে অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। ১৯৬৯ সালের ১৬ জানুয়ারি পাঠানো সুয়োজ ছিল প্রথম পরীক্ষামূলক স্পেস স্টেশন। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে রাশিয়া, কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিলে মহাকাশের স্থায়ী আন্তর্জাতিক স্টেশন স্থাপন করে।
নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর পৃথিবী থেকে গবেষকদের একটি দল এ স্টেশনে গিয়ে অবস্থান করেন এবং আধুনিক সব প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির মাধ্যমে নতুন নক্ষত্রসমূহের উপর গবেষণা কার্য পরিচালনা করেন।
স্পেস স্টেশনের কিছু কিছু যন্ত্র বিকল হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে অনেক সময় নভোচারীদের স্পেস স্টেশনের বাইরে এসে সেগুলো সরিয়ে নিতে হয়। জীবনের মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে বিজ্ঞানীরা এই সব কাজ করে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে তারা পুরো কার্যক্রম পরিচালনা করেন কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ বিভিন্ন রোবটিক ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিজেদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে।
মহাকাশ অভিযানের জন্য বিজ্ঞানীরা স্পেস শাটল তৈরি করেছেন। স্পেস শাটল এর বৈশিষ্ট্যগুলো এটির মূল অংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য মহাকাশযান দ্য অরবিটাল; যা মহাকাশে উৎক্ষেপণ হবে রকেট এর সাহায্যে, কিন্তু পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবে এরোপ্লেন এর মত, রানওয়ে অনুসরণ করে।
মানুষের প্রথম মহাকাশ অভিযানের 20 বছর পূর্তি উপলক্ষে স্পেস শাটল কলম্বিয়া কক্ষপথে পৌঁছায়। কলম্বিয়া চ্যালেঞ্জার, ডিসকভারি আটলান্টিস স্পেস শাটল মহাকাশ গবেষণায় বহু ক্ষেত্রে নজির স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।
১৯৮৩ সালের ১৮ জুন শাটল চ্যালেঞ্জার বাহিত হয়ে প্রথম মহাকাশ যাত্রা করেন আমেরিকার প্রথম মহিলা অভিযাত্রী স্যালিরাইড। ১৯৮৬ সালের ২৯ জানুয়ারি আমেরিকার মহাকাশ অভিযান পর্ব প্রথম ধাক্কা খায়। তখন তাদের স্পেস উৎক্ষেপণের মাত্র ৭৫ সেকেন্ডের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যায়। এতে করে ছয় জন পুরুষ ও একজন মহিলা সহ মোট সাতজন অভিযাত্রীর সবাই মারা যায়।
কিন্তু আশার কথা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবার বিপুল আগ্রহে মহাকাশ গবেষণায় সচেষ্ট হয় এবং ১৯৮৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পাচজন যাত্রীসহ শাটল ডিসকভারি মহাশূন্যে পাঠায়।
১৯৯০ সালের ৯ অক্টোবর মার্কিন স্পেস শাটল ডিসকভারি সূর্যের মেরু অঞ্চলীয় তথ্য জানার জন্য মহাকাশযান ইউলিসিস উৎক্ষেপণ করে।
বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মত মহাকাশ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গবেষণার কাজ করে যাচ্ছে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বৃহৎ ও ব্যাপক পরিসরে গবেষণার জন্য ১৯৫৮ সালের ২৯ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয় নাসা (NASA – National Aeronautics And Space Administration)।
নাসার বিজ্ঞানীরা প্রায় 100 বার মহাশূন্যে মনুষ্যবাহী অভিযান পরিচালনা করেছে এবং ব্যর্থ হয়েছে মাত্র দুইবার। ১৯৮৬ সালে চ্যালেঞ্জার বিস্ফোরণ এবং ২০০৩ সালে কলম্বিয়া বিপর্যয়। একই উদ্দেশ্যে ইউরোপের ১৮ টি দেশের সম্মিলিত প্রয়াস ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসা (ESA- European Space Agency) মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ অবিরাম পৃথিবীর রহস্য উন্মোচন করে চলেছে এবং বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ ও গবেষণার জন্য বিভিন্ন কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠাচ্ছে মহাকাশে।
বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বাইরে বসবাসের জন্য বিভিন্ন গ্রহে গবেষণা করে চলেছে। ইতোমধ্যে নাসার বিজ্ঞানীরা জীবন ধারণের উপযোগী দুটি পৃথিবী সদৃশ গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন।
কেপলার “৬২- এফ” এবং “৬২-ই” গ্রহ দুটি প্রাণীর বসবাসের উপযোগী। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে মানুষ নতুন কোন গ্রহে বসবাস করবে।
মহাশূন্যের রহস্য উদঘাটনের জন্য বিজ্ঞানীরা নিরন্তন কাজ করে যাচ্ছে একথা যেমন সত্য তেমনি পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো একপ্রকার যুদ্ধে শামিল হচ্ছে এইসব অভিযানের মাধ্যমে। মহাকাশে তারা আধিপত্য ধরে রাখতে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করছে।
একটি নবজন্ম তৈরি করতে কোটি কোটি বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিস্ফোরণ ঘটলে বিপুল টাকার ক্ষয়ক্ষতিও হয়। প্রতিযোগিতামূলক অভিযানের ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া মহাকাশযান বিস্ফোরণের ফলে মহাশূন্যে আবর্জনা সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রাসঙ্গিক লেখা-