ভিটামিন এ, ডি, ই এবং কে’র ঘাটতি জনিত রোগ

ভিটামিন এক প্রকার জৈব ভিত্তিক পদার্থ। ইংরেজিতে “অর্গানিক সাবসটেনস” বলা হয়। ভিটামিন, “মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্টসে”র অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ, শরীরের সুস্থতা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান, যেগুলো পরিমাণে কম প্রয়োজন হয়, এবং দেহাভ্যন্তরে নিজে থেকে তৈরী হয় না। ফলে, বাইরে থেকে এই পুষ্টি উপাদান শরীরকে সরবরাহ করতে হয়।

শরীরের বিভিন্ন বিপাকীয় কাজের জন্য ভিটামিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা দুই প্রকার। যথা-

১। ফ্যাট সলিউবল ভিটামিন।
২। ওয়াটার সলিউবল ভিটামিন।

ভিটামিন এ, ডি, ই এবং কে ফ্যাট সলিউবল ভিটামিন। ভিটামিন বি কমপ্লেক্স গ্রুপ এবং ভিটামিন সি, ওয়াটার সলিউবল ভিটামিন। আমাদের আজকের আলোচনা ফ্যাট সলিউবাল ভিটামিন নিয়ে।

ভিটামিন ঘটিত অভাবের একটি সামগ্রিক চিত্র

মূলতঃ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, যেমন আমাদের দেশে, ভিটামিনের অভাব জনিত অসুস্থতা বেশী দেখা যায়। তবে উন্নত দেশগুলোতেও এমন রোগী পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। সাধারণতঃ বৃদ্ধ মানুষ অথবা যারা মধ্যপান করে থাকেন তারা ভিটামিন বি, ভিটামিন ডি এবং সি’এর অভাবজনিত উপসর্গগুলোর ঝুঁকিতে রয়েছেন।

গর্ভকালীন সময়ে মা’র যদি ভিটামিনের ঘাটতি হয়, তাহলে মা এবং অনাগত সন্তান দু’জনই ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেন। এজন্য, চিকিৎসকের পরামর্শ সাপেক্ষে, গর্ভাবস্থায় মায়ের জন্য বাড়তি ভিটামিন গ্রহণ করা জরুরী।

সমতল ভূমি থেকে উঁচু জায়গায় বাস করেন, ত্বকের বর্ণ কালো, যারা বাইরে রোদে যান না, বা শরীর অতিরিক্ত ঢেকে রাখেন (যেমন বোরকা, হিজাব পরেন যারা) -তাদের ক্ষেত্রে সূর্যালোকের অভাব জনিত কারণে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হতে পারে। এই ধরণের ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের আলাদা ভাবে ভিটামিন ডি গ্রহণ করা প্রয়োজন হয়।

অনেক সময় বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি , কড়া ঔষধ সেবনের কারণেও ভিটামিনের অভাব হতে পারে। ফ্যাট ম্যাল-অ্যাবসর্পশান বা শরীর যদি স্নেহ জাতীয় পদার্থকে সঠিক উপায়ে প্রকিয়াকরণ করতে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে ফ্যাট সলিউবাল ভিটামিনগুলোর ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

ভিটামিন-এ কি ও কেন প্রয়োজন?

ভিটামিন ‘এ’কে রেটিনলও বলা হয়। প্রাণিজ উৎসের খাদ্যগুলোতে রেটিনল পাওয়া যায়। ক্যারোটিন থেকেও ভিটামিন এ পাওয়া যতে পারে। শুধুমাত্র সবুজ এবং রঙিন শাকসবজিতে ক্যারোটিন থাকে। যারা নিরামিষ, শুধুমাত্র শাকসবজি খান, তাদের জন্য ক্যারোটিন তথা শাকসবজি ভিটামিন এ’র একমাত্র উৎস।

রেটিনল শরীরে প্রবেশ করার পর আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ অণুতে রূপান্তরিত হয়। যেমনঃ

* ১১-সিস-রেটিনালডিহাইড : এই অণুটি চোখের রেটিনার ফটোরিসেপ্টার কমপ্লেক্সের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
* রেটিনয়িক এসিড : ত্বকের এপিথেলিয়াল কোষের নিউক্লিয়াসের রিসেপ্টরে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে রেটনয়িক এসিড কোষগুলোর জেনেটিক কার্যক্রমকে সক্রিয় করে। এর ফলে, ত্বকের কোষগুলো বিভাজিত হয়। ভিটামিন এ-র অভাবে মিউকাস নিঃসরণকারী কোষগুলোর স্থান নেয় কেরাটিন সৃষ্টিকারী কোষ। যেকারণে ভিটামিন এ’র অভাবে ত্বক রুক্ষ হয়ে যায়।
* রেটিনেয়ড : দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, গর্ভাবস্থায় শিশুর বৃদ্ধি, মানুষের প্রজনন সক্ষমতা, রক্তকোষ তৈরী, এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য রেটিনয়েড প্রয়োজন। সুতরাং ভিটামিন এ’র অভাব হলে এই বিষয়গুলোতে সমস্যা দেখা দিবে।

ভিটামিন-এ সম্পর্কিত দৃষ্টিহীনতা

বিশ্বজুড়ে, ভিটামিন এ’র অভাব জনিত সবচেয়ে মারাত্নক পরিণতি হল শিশুদের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া। ভিটামিন এ’র ঘাটতিতে যে অন্ধত্ব, সেটি সাধারণতঃ চিকিৎসার মাধ্যমে ঠিক করা যায় না। এই সমস্যাটি সবচেয়ে বেশী দেখা যায় এশিয়ায়। বৃহৎ পরিসারে সকল শিশুকে ভিটামিন-এ সাপ্লিমেন্ট প্রদান কার্যক্রমের মাধ্যমে সমস্যাটিকে মোকাবেলার চেষ্টা করা হচ্ছে।

প্রাপ্তবয়স্কদের সাধারণতঃ এই ভিটামিন-এ জনিত অন্ধত্বের ঝুঁকি নেই। কারণ লিভার কিছু ভিটামিন-এ জমা করে রাখতে পারে। কোন ব্যাক্তি যদি ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ থেকে কিছুদিন বিরত থাকেন, লিভার তখন ঘাটতি পূরণের জন্য তার সঞ্চিত ভিটামিন-এ নিঃসরণ করে থাকে।

ভিটামিন-এ’র অভাবজনিত দৃ্ষ্টহীনতা প্রাথমিক পর্যায়ে ‘নাইট ব্লাইন্ডনেস’ বা রাতকানা রোগ দেখা দেয়। রাতের বেলার ক্ষীণ আলোতে রোগী কিছুই দেখতে পান না।

ভিটামিন এ’র অভাবে চোখের কর্ণিয়ার, কেরাটিনাইজেশান ঘটে। একে বলা হয় “জেরোপথালমিয়া”। এর ফলে চোখে “বাইটোটস স্পট” দেখা যায়। পরবর্তীতে এটি “কেরাটোম্যালাসিয়া”-য় অগ্রসর হয়। তারপর কর্ণিয়ায় আলসারের সৃষ্টি হয়। আলসারের পরিণতিতে চোখে ক্ষতস্থান তৈরী হয়। চূড়ান্ত পরিণতি অন্ধত্ব। এই অন্ধত্বের কোন চিকিৎসা এখন পর্যন্ত নেই।

যেসব দেশে ভিটামিন এ’র ঘাটতি অতি প্রচলিত বিষয়, সেখানে গর্ভকালীন অবস্থায় মায়েদের গাঢ় সবুজ শাকসবজি, হলুদ ফল খেতে হবে। এর ফলে গর্ভের শিশুর লিভার রেটিনল জমা করে রাখতে পারবে। শিশু মুখে খাওয়া শুরু করার পর, তাকেও এসব খাবার দিতে হবে।

যেসব অঞ্চলে জেরোপথ্যালমিয়া দেখা যায়, সেখানে ওয়ার্লড হেলথ অর্গানাইজেশান অন্ধত্ব প্রতিরোধের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এই মর্মে এখনও স্কুলে যায় না, এ রকম ছোট শিশুদের, ৬০ মিগ্রা রেটিনাইল পালমিটেট (এর ভেতরে ২০০,০০০ ইউনিট রেটিনল থাকে) মুখে খাওয়ানোর কার্যক্রম পরিচালনা করে ডব্লিউ-এইচ-ও। গ্যাস্ট্রোএন্টারাইটিস, এবং শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন সংক্রমণ জনিত মৃত্যুহারও এর মাধ্যমে কমিয়ে আনা যায়।

আরও পড়ুন-

অতিরিক্ত ভিটামিন-এ গ্রহণ করার সমস্যা

রেটিনল অপরিমিত ও অতিমাত্রায় গ্রহণ করলেও বিপদ। নানান ধরণের সমস্যা দেখা দেয়। অতিরিক্ত রেটিনল গ্রহণের ফলে লিভার নষ্ট হয়ে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে হাড়ের অতিবৃদ্ধি বা হাইপার-অস্টোসিস দেখা দেয়।

মা যদি পর্যাপ্ত পরিমাণের চেয়ে বেশী ভিটামিন-এ গ্রহণ করেন তাহলে গর্ভের শিশুটির মৃত্যুও হতে পারে। যেকারণে, যেসব দেশে ভিটামিন-এ’র অভাব জনিত রোগের প্রাদুর্ভাব নেই সেখানে ভিটামিন-এ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়।

অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ক্ষয়ে ভুগছেন, এমন মানুষদের ক্ষেত্রেও ভিটামিন-এ গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়।

হঠাৎ একসাথে অনেক বেশী ভিটামিন-এ গ্রহণের ফলে বমি ভাব, মাথাব্যাথা, ইন্ট্রাক্র্যানিয়াল প্রেশার বা মাথার খুলির অভ্যান্তরের চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।

অতিমাত্রায় ভিটামিন-এ গ্রহণের করলে ‘স্কিন ডিস্কোয়ামেশান’ বা ‘চামড়া উঠে আসা’র সমস্যা দেখা দিতে পারে।

খুব বেশী পরিমাণে ক্যারোটিনে গ্রহণ করলে ত্বকের পিগমিন্টেশান হয়, অর্থাৎ ত্বকের বর্ণ পাল্টে যেতে পারে (কমলাটে রঙ হয়ে যায় সাধারণতঃ)। এই ঘটনাকে বলে হাইপারক্যারোটেনোসিস।

ভিটামিন গ্রহণ কমিয়ে দিলে ত্বকও তার স্বাভাবিক বর্ণ ফিরে পায়।

ভিটামিন-এ (রেটিনল) সমৃদ্ধ খাবার :

কলিজায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ থাকে। যেমন : একবেলা খাবারে গরুর কলিজা রাখলেই আপনার সমস্ত ভিটামিন-এ’র চাহিদা পূরণ হয়ে যাবে। এছাড়াও, দুধ ও দগ্ধজাতীয় খাবার, ডিম, মাছের তেল ভিটামিন এ -র চমৎকার উৎস।

প্রতিদিন সর্বোচ্চ যতটুকু ভিটামিন-এ গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি: পুরুষ ৭০০ মাইক্রোগ্রাম, মহিলা ৬০০ মাইক্রোগ্রাম।

ভিটামিন-ডি কি ও কেন প্রয়োজন?

ভিটামিনের-ডি এর প্রাকৃতিক রূপটিকে বলে কোলেক্যালসিফেরোল বা ভিটামিন ডি-থ্রী।

মানুষের ত্বকের ‘৭-ডিহাইড্রেক্সিকোলেস্টোরোলের’ ওপর অতি বেগুনী রশ্মির ক্রিয়ার ফলে কোলেক্যালসিফেরোল তৈরী হয়। “৭- ডিহাইড্রোক্সিকোলেস্টেরোল” এমন একটি যৌগ যা কোলেস্টেরোলের বিপাক থেকে সৃষ্টি হয়।

ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাদ্যের সংখ্যা খুব কম। সুতরাং সূর্যরশ্মিই ভিটামিনি ডি’র প্রধান উৎস। বিষুবরেখা থেকে আপনি যত দূরে সরবেন অতি বেগুনী রশ্মির তীব্রতা ততই কমতে থাকবে। ফলে পঞ্চাশ ডিগ্রী অক্ষরেখার পরবর্তী এলাকাগুলোতে শীতকালে ভিটামিন-ডি তৈরী হয় না মানুষদের শরীরে।

এই ভিটামিন-ডি তৈরী না হওয়া এলাকাগুলোর ভেতরে উত্তর ইউরোপও রয়েছে। এমনকি তিরিশ ডিগ্রী অক্ষাংশের অঞ্চলগুলোতেও ঋতুভেদে ভিটামিন ডি তৈরী হওয়া বন্ধ থাকে। এই দেশের লোকেরা গ্রীষ্মকালে শরীরে যতটুকু ভিটামিন-ডি জমা করতে পারেন তাই দিয়ে শীতকালটা চালিয়ে নেন।

লিভারে ভিটামিন ডি – “ ২৫-হাইড্রোক্সি-ভিটামিন-ডি”ত- রূপান্তরিত হয়। এই যৌগটির কিডনীতে এসে আরও হাইড্রোক্সিল প্রাপ্তি ঘটে। পরিণত হয় – “১,২৫-ডাই-হাইড্রোক্সি-ভিটামিন-ডি”। এই যৌগটিই ভিটামিন-ডি’র সক্রিয় রূপ। “১,২৫-ডাই-হাইড্রোক্সি-ভিটামিন-ডি” আন্তঃকোষীয় কিছু নির্দিষ্ট রিসেপ্টারকে ( অর্থাৎ যৌগটির প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারবে এরকম কিছু আণবিক কাঠামো) সক্রিয় করে দেয়।

যে রিসেপ্টরগুলো সক্রিয়া করা হল, তারা আবার মানবদেহের ক্যালসিয়াম বিপাককরণ, হাড়কে খনিজে সমৃদ্ধ করা এবং টিস্যু বা দেহকলার বিভাজন ও বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। যেকারণে , ভিটামিন-ডি’র অভাব হলে, আপনার শরীর ক্যালসিয়াম জনিত সমস্যাগুলোতে ভুগে থাকে।

ভিটামিন-ডি’র প্রাকৃতিক রূপ অর্থাৎ ‘ভিটামিন ডি থ্রী’র তুলনায়, ভিটামিনটির কৃত্রিম রূপ – আর্গো-কোলে-ক্যালসিফেরোল বা ‘ভিটামিন-ডি টু’ কম কার্যকর।

ভিটামিন-ডি পরিমিত গ্রহণ করলে “ রিকেটস ” এবং “ ওস্টিওম্যালেসিয়া ” রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি, মাংস পেশীর শক্তি বাড়ায়। এবং বয়স্ক মানুষদের পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটা থেকে রক্ষা করে। হাড় ও পেশীতন্ত্রের সাথে সম্পর্কহীন অনেক সমস্যাও পরিমিত ভিটামিন-ডি গ্রহণের মাধ্যমে সমাধান করা যায়।

উন্নত দেশগুলোতে – মার্জারিন, দুধ এসব খাবারে পর্যাপ্ত ভিটামিন-ডি যোগ করে দেওয়া হয়।

যেসব দেশে সূর্যালোকের সমস্যা আছে, সেখানে পাঁচ বছরের বেশী বয়সী সবাইকে প্রতিদিন ১০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন-ডি গ্রহণ করতে বলা হয়।

রোদে একেবারেই যান না এমন মানুষরা ভিটামিন-ডি’র অভাবজনিত উপসর্গের ঝুঁকিতে থাকেন। যারা সারাদিনই ঘরে থাকেন, যেমনটা করোনা মহামারির লকডাউনের সময় মানুষকে থাকতে হয়েছিল, তাদেরও এই ভিটামিনের অভাবজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।

তাছাড়া যেসব মানুষের গায়ের রঙ কালো অথবা বাইরে গেলেই সমস্ত শরীর আপাদমস্তক ঢেকে বের হন, তাদেরও সারা বছরই প্রতিদিন ১০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন-ডি গ্রহণ করা উচিত। অন্যদের ক্ষেত্রে শীতকালের সময়টায় গ্রহণ করলেই পর্যাপ্ত। যদিও আমাদের দেশের শীতকালে রোদের অভাব তেমন প্রকট নয়।

ত্বকের রোগ “ সোরিয়াসিস” চিকিৎসার জন্য ভিটামিন-ডি’র অনুরূপ আণবিক গঠনসম্পন্ন একটি যৌগ ক্যালসিপোট্রায়োল ব্যবহার করা হয়।

ক্যালসিফেরোল, আর্গোক্যালসিফেরোল এগুলো অতিরিক্ত গ্রহণ করলে হাইপারক্যালসেমিয়া হতে পারে। অর্থাৎ, শরীরে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বেড়ে গিয়ে বিভিন্ন প্রকার জটিলতা দেখা দেয়।

ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার : মাছের তেল, ডিমের কুসুম। ২১৮ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট ভিটামিন-ডি থাকে ডিমের কুসুমে। তাছাড়াও ভিটামিন-ডি যুক্ত করে দেয়া মার্জারিন, সিরিয়াল এসবও ভাল উৎস। তবে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস সূর্যের আলো।

দৈনিক যতটুকু ভিটামিন ডি গ্রহণ করবেন : ১০ মাইক্রোগ্রাম। এটি একমাত্র যারা রোদে যান না, বাইরে বের হতে পারেন না তাদের জন্য প্রযোজ্য।

প্রয়োজন মনে হলে পড়ে নিতে পারেন-

ভিটামিন-ই কি কাজে প্রয়োজন হয়?

ভিটামিন-ই’র কার্যক্রমের সাথে আরও আটটি ফ্যাট-সলিউবাল ( স্নেহ জাতীয় ঝিল্লী ভেদ করতে পারে এমন পদার্থ) যৌগের সম্পর্ক রয়েছে। ভিটামিন-ই’র খাদ্যে গ্রহণযোগ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রূপটির নাম আলফা-টোকোফেরোল। ভিটামিন-ই’র অনেক প্রত্যক্ষ বিপাকীয় ক্রিয়াকলাপ রয়েছে। যেমন-

কোষ ঝিল্লীর পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি-এসিডের অক্সিডেশান ঘটায় ফ্রি-রেডিকেলস। এর ফলে কোষ ঝিল্লীর ক্ষয় ঘটে। ভিটামিন-ই এটি ঘটতে দেয় না।

কোষের ঝিল্লীর গঠন অক্ষত রাখে ভিটামিন-ই।

ডিএনএ তৈরী এবং কোষের মাঝে সংকেত আদানপ্রদানে ভূমিকা রাখে ভিটামিন-ই।

প্রদাহ প্রতিরোধ এবং রোগ প্রতিরোধে ভিটামিন-ই কাজ করে।

মানুষের ক্ষেত্রে ভিটামিন-ই’র অভাব সাধারণতঃ দেখা যায় না। শুধুমাত্র ‘প্রি-ম্যাচিওর’ নবজাতক এবং যাদের শরীরে খাদ্য পরিপাক পরবর্তী শোষণ প্রক্রিয়াটিতে কোন ঝামেলা আছে তাদের ক্ষেত্রেই এই ভিটামিনের ঘাটতি জনিত উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

ভিটামিন-ই’র অভাবে হেমোলাইটিক এনিমিয়া দেখা দিতে পারে। স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা – ‘এট্যাক্সিয়া’র – উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে পারে। যেমন রোগীর কথা জড়িয়ে যাবে, দেহের ভারসাম্য রাখতে পারবেন না। এই ভিটামিনের অভাবে আংশিক দৃষ্টিহীনতায় ভুগতে পারেন রোগী।

ভিটামিন-ই সাধারণতঃ তিন থেকে চার মিগ্রা গ্রহণ করতে বলা হয়। কিন্তু এর চেয়ে একহাজার গুণ বেশী , অর্থাৎ দিনে ৩২০০ মিগ্রা গ্রহণ করলেও বিপদের কিছু নেই।

ভিটামিন-ই হৃদযন্ত্রের সুস্থতায় প্রত্যক্ষ কি ভূমিকা রাখে সেটি এখনও জানা যায় নি, কিন্তু যেসব দেশে ভিটামিন-ই সমৃদ্ধ খাবার খায় মানুষ, দেখা গেছে সেখানে করোনারী হার্ট ডিজিজের প্রাদুর্ভাব কম।

ভিটামিন-ই সমৃদ্ধ খাবার : সানফ্লাওয়ার-ওয়েল, সবজি, বাদাম, বীজজাতঃ তেল।

প্রতিদিন যতটুক ভিটামিন-ই গ্রহণ পর্যাপ্ত : তিন থেকে চার মিগ্রা।

ভিটামিন-কে কেন প্রয়োজন?

যুক্তরাজ্য ও সংলগ্ন এলাকাগুলোতে মানুষ খাদ্যে ভিটামিন-কে এর যে রূপটি গ্রহণ করে সেটি ভিটামিন-কে ওয়ান বা ফাইলোকুইনোন। অন্যদিকে, এশিয়ার লোকরা মলূতঃ গাঁজনলব্ধ বিভিন্ন খাবার যেমন : দধি , পনির থেকে ভিটামিন-কে পেয়ে থাকেন। এসব খাবারের ভিটামিন-কে’র রূপটির নাম ভিটামিন-কে টু বা মেনাকুইনোন। তাছাড়া মলাশয় বা কোলনের ব্যাকটেরিয়াও ভিটামিন-কে টু তৈরী করে থাকে।

আমাদের শরীরে রক্তজমাট বাঁধার প্রক্রিয়াটি কিছু ফ্যাক্টর-প্রোটিনের ওপর নির্ভরশীল। এই প্রোটিনগুলোর প্রতিটিতেই একটি অন্যতম উপাদান “ জি-এল-এ” বা গামা-কার্বোক্সিগ্লুটামেট। এই গামা-কার্বোক্সিগ্লুটামেট উৎপন্ন কার্বোক্সিলেশান বিক্রিয়ার মাধ্যমে। এবং এই বিক্রিয়াটির অন্যতম সহ-ঘটক ভিটামনি-কে। যেকারণে রক্তজমাট বাঁধার প্রক্রিয়া ভিটামিন-কে’র ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জি-এল-এ প্রোটিন হচ্ছে অস্টিওক্যালসিন এবং ম্যাট্রিক্স জেল প্রোটিন। হাড়কে খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধকরণে এই প্রোটিণগুলো গুরুত্বপূর্ণ।

ভিটামিন কে’র অভাবে রক্ত জমাট বাঁধায় জটিলতা দেখা দেয়। এই ভিটামিনের অভাবে ভুগছেন এমন ব্যাক্তির জন্য সামান্য আঘাত এবং রক্তপাত ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। কোন ধরণের সার্জারীর প্রয়োজন হলেও সার্জনরা এসব রোগী চিকিৎসা করতে শঙ্কিত বোধ করেন। কারণে রক্তক্ষরণ জনিত জটিলতায় অপারেশান থিয়েটারের টেবিলেই মারা যেতে পারেন রোগী।

অবস্ট্রাকটিভ জন্ডিসের রোগীদের ক্ষেত্রে ডায়েটারী ভিটামিন-কে সাধারণতঃ শরীরে শোষিত হয় না। সুতরাং সার্জারীর পূর্বে , শিরাপথে ভিটামিন-কে দেয়া হয়ে থাকে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এবং ভুললে চলবে না।

অনেক সময় রক্তের গুণগত সমস্যা বা অন্য কোন কারণে ক্লট বা রক্তপিন্ডের সৃষ্টি হয়। এরকম ক্লট বা রক্তপিন্ড হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক বা শরীরের অন্য যেকোন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে রক্তবাহী নালিকাকে বন্ধ করে দিতে পারে। এসব ক্ষেত্রে সাধারণতঃ রক্ত পাতলা করার ঔষধ হিসেবে পরিচিত “ ওয়ারফারিন” ব্যবহার করা হয়। এই ওয়ারফারিনে প্রধান কার্যকৌশল হচ্ছে ভিটামিন-কে’ কে কাজ না করতে দেয়া।

নবজাতকদের প্রায় সময়ই ভিটামিন-কে দেয়া হয়। বিভিন্ন রক্ত-জনিত রোগব্যাধি বা হেমোরেজিক ডিজিজ থেকে শিশুকে রক্ষার জন্যই ভিটামিন-কে দেয়া হয়।

অতিরিক্ত ভিটামিন-কে জনিত সমস্যার কথা সাধারণতঃ শোনা যায় না। নবজাতকদের হেমোরেজিক ডিজিজ প্রতিকারের উদ্দেশ্যে কৃত্রিম ভিটামিন কে ব্যবহার করলে অনেক সময় লিভারের ক্ষতি হয়েছে এমন নজির আছে।

ভিটামিন-কে সমৃদ্ধ খাবার: সয়া অয়েল, অন্ত্রে তৈরী হওয়া মেনাকুইনোন।

ভিটামিন-কে প্রতিদিন কতটুকু গ্রহণ করবেন: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের সাপেক্ষে এক মাইক্রোগ্রাম।

ভিটামিন অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পুষ্টি উপাদান। ফ্যাট সলিউবাল ভিটামিন গুলোর একটি সুবিধা হল, ফ্যাট সলিউবাল হওয়ার কারণে রান্না করা খাবারেও এই ভিটামিন অক্ষুন্ন থাকে। প্রতিদিনই যে ভিটামিন গ্রহণ করতে হবে এমন নয়।

নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার দাবার খেলে এবং সুশৃঙ্খল সহজ স্বাভাবিক জীবন যাপন করলেই এই ভিটামিনগুলোর চাহিদা পূরণ হয়ে যাওয়ার কথা। তারপরও যদি ভিটামিনগুলোর ঘাটতি জনিত উপসর্গ দেখতে পান, সেক্ষেত্রে প্রথমে চিকিৎসকের শরাপন্ন হোন।

ডাক্তার আপনাকে কিছু বায়োকেমিকাল টেস্ট দিবেন। এই টেস্ট বা আপনার শরীরের জৈব-রাসায়নিক অবস্থাটি যাচাই করে বোঝা যাবে প্রকৃতই আপনার ভিটামিনের অভাব রয়েছে কিনা।

ভিটামিনের যে বিভিন্ন সক্রিয় ও বিপাকলব্ধ রূপগুলোর কথা আলোচনা করা হল সেগুলো পরিমাপ করেই এ সিদ্ধান্তে আসবেন ডাক্তার। এবং তারপরই, একমাত্র চিকিৎসক বললেই, আপনি ভিটামিনের সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে পারেন।

অন্যথায় অতিরিক্ত ভিটামিন গ্রহণের উপসর্গগুলোর শিকার হতে পারেন।

সবাই সুস্থ থাকুন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।

রেফারেন্স : লিপিনকটস বায়োকেমিস্ট্রি সর্বশেষ এডিশান, পার্কস কমিউনিটি মেডিসিন, অক্সফোর্ড মেডিসিন, ডি-গ্রুচি হেমাটোলজি এবং চিকিৎসা পেশায় লেখকের ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা।

লেখক : ডা. সালেহ মুহাম্মাদ এম.বি.বি.এস (ডিইউ)।

প্রয়োজন মনে হলে পড়ে দেখতে পারেন-

Leave a Comment