ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরনীয় অধ্যায়। চেতনায় উজ্জীবিত এক প্রতিবাদী স্ফূরণ। কারণ পৃথিবীর বৈচিত্রময় সকল ভাষাই মহান আল্লাহর অসাধারণ নিয়ামত। এ নিয়ামতকে ছিনিয়ে নেবার কেউ অপপ্রয়াস চালালে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন।
এ আন্দোলন বাঙালী জাতির সত্তাকে যেমন শাণিত করেছে। তেমনি রুখে দাঁড়াবার শক্তি যুগিয়েছে সকল অন্যায়-অত্যাচার নিপীড়ন, নির্যাতন ও শোষনের বিরুদ্ধে। ভাষা আন্দোলন সকল বাংলাদেশীর সত্ত্বাকে ছুঁয়ে হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। অনুভূতিকে উদ্বেলিত করেছে। কিন্তু বহমান এই সময়ে মনোবেদনা ও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় যখন ভাষা আন্দোলনের উৎপত্তি ও উৎসের ইতিহাসকে অতি সূক্ষভাবে খন্ডিত করা হয়।
এটা হয়েছে মূলতঃ সেক্যুলার শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক তথ্য উপাত্ত উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকার কারণে।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এ আন্দোলনের মিছিলে বরকত, সালাম, রফিক ও জব্বারের শহীদ হওয়া দিয়েই ইতিহাস লেখা শুরু।
এটাই জানি।
কিন্তু সেদিন যারা ভাষা আন্দোলনে হানাদারের বুলেট বৃষ্টির সামনে নেতৃত্ব দিয়েছিলো, যাদের অকুতোভয় নেতৃত্বে সারাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল গণজোয়ার।
তারা কারা সেদিন নেতৃত্ব দিয়েছিল। তারা কেন আজ উপেক্ষিত?
প্রশ্ন থেকেই যায়। কখনো কি ভেবেছি, প্রতিবছর ফাগুন তথা ২১ ফেব্রুয়ারীতে আমাদের সুশীল ও বুদ্ধিজীবীরা পত্র-পত্রিকায় একুশের গান, চেতনার কথা বলেন। কিন্তু অতি কৌশলে এসব সেক্যুলার শ্রেণী আলেমদের স্বর্নোজ্জল অবদান, ও ত্যাগকে আলোচনা না করে পাশ কেটে যান, উপেক্ষা করেন।
বত্তুত ১৯৪৭ সালের আগেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।
প্রেরণার বাতি ঘর সেখানেই। আন্দোলনের সুপ্তবীজ প্রোথিত সেখানেই।
কিন্তু সে সময়ের ভাষা আন্দোলনের অংগ সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের কথা চাপা পড়েছে চোরা বালিতে।
ভাষা আন্দোলনের ডামাডোলে হারিয়ে গেছে আন্দোলনের জনক খ্যাত প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের কথা।
৫২’র ভাষা আন্দোলনের সূত্রপত্রে “সাপ্তাহিক সৈনিকের” কথা।
আজ বায়ান্নর আন্দোলন থেকে হারিয়ে গেছেন, মাওলানা ভাসানী ও তর্কবাগিশরা।
হারিয়ে গেছেন, মাওলানা আতাহার আলী (রহ:) এর মতো আলেমদের ভাষা যুদ্ধে ভূমিকা ও আন্দোলনের কথা।
৫২’তে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভীত গড়ে উঠা “তমদ্দুন মজলিসের” অগ্রজ নেতৃত্বের কথা বর্তমান প্রজন্ম জানেনা।
ভাষা আন্দোলনের প্রোথিত বীজ এর দিকে তাকালে প্রকৃত ইতিহাস উদ্ভাসিত হয়ে প্রকাশ পায়।
সর্বপ্রথম মাওলানা আকরাম খাঁ সংগ্রাম ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে ১৮৯৯ সালে কলকাতা আলিয়া মাদরাসার বাংলা ভাষাকে শিক্ষা মাধ্যমে হিসেবে সিলেবাসভূক্ত ও অনুমোদন করা হয়।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন ৫২’র সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি। এছাড়া তিনি ২১’শে ফেব্রুয়ারী হত্যাকান্ডের প্রথম প্রতিবাদকারীও ছিলেন।
মাওলানা তর্কবাগিশ ভারতের দেওবন্দ মাদরাসার শিক্ষা জীবন সম্পন্ন করেন। তিনি একদিকে যেমনি ছিলেন বিজ্ঞ আলেম, অপর দিকে ছিলেন দক্ষ সংগঠক।
আমরা সংগঠকের ভূমিকায় আরোও দেখতে পাই, ইসলামি ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত “রাজনীতিতে বঙ্গীয় ওলামার ভূমিকা” গ্রন্থে ড. মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ লিখেছেন; “১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সে সময় বাংলার প্রখ্যাত আলেম মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচ বাগী পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেন এবং বাংলা ভাষা অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী তোলেন।
ঐতিহসিক দলিল মতে, ১৯৫২ সালের ১৮, ১৯,ও ২০শে মার্চ কিশোরগঞ্জের হযরত নগরে অনুষ্ঠিত হয় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ঐতিহাসিক সম্মেলন।
এই সম্মেলনে গৃহিত প্রস্তাবগুলোর মধ্যে একটি ছিল চতুর্থ প্রস্তাব। (খ) পূর্ব পাকিস্তানের জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এই সম্মেলনে; পাকিস্তান গণপরিষদ এর নিকট দৃঢ়তার সহিত দাবী জানাইতেছে যে, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করা হোক।
আর এই সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন মাওলানা আতাহার আলী (রহ:)। একই দাবী ছিল পশ্চিম পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পাটিরও।
তাই ভাষা আন্দোলনে আলেমদের অবদান কিংবা ভূমিকা অধিকার করার সুযোগ নেই। অথচ অনেকে অতি উৎসাহে নির্লজ্জভাবে আলেম উলামাদের উর্দুপন্থী হিসেবে প্রচারের অপচেষ্টা চালায়।
আর ইতিহাস বিকৃতকারীরা নাটক, নভেল উপন্যাসে একথা বুঝাতে চেষ্টা করে যে, হুজুর, দাঁড়ি, টুপি মানেই উর্দু প্রেমী। ভাষা আন্দোলনে আলেমদের ভূমিকা ছোট করলে প্রকারান্তরে ভাষা আন্দোলনকেই ছোট করা হবে। কষ্ট দেয়া হবে শহীদদের আত্মাকে। তাদের ত্যাগকে অসম্মান করে কলুষিত করা হয় ইতিহাসকে।
লেখকঃ
মুফতী আনোয়ার শাহ
প্রতিষ্ঠাতা- আল মারকাজুল আমানাহ্ মোমেনশাহী।
তারিখ: ২৮/০১/২০২০
প্রাসঙ্গিক লেখাসমূহ-