ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তির উপায়!

ফ্যাটি লিভার শব্দটি মানুষের স্বাস্থ্যের সাথে সম্পৃক্ত হয় মানুষের নিজের প্রতি অবহেলার প্রতিফল হিসেবে। আসুন জেনে নিই এই ফ্যাটি লিভার কি এবং একই সঙ্গে ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তির উপায় সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত সবকিছু।

ফ্যাটি লিভার কি?

চর্বি বা মেদযুক্ত যকৃত (ফ্যাটি লিভার) রোগ হল এমন একটি রোগ যাতে লিভারে (যকৃতে) অতিরিক্ত চর্বি জমা হয়। কেন এটিকে অবহেলিত রোগ হিসেবে ধরা হয়?

আজ থেকে পাঁচ বছর আগে থেকে আলট্রাসনোগ্রাম করা হলে সাধারণত ফ্যাটি লিভার বেশি চিহ্নিত হতো। সাধারণত মানুষ একে খুব একটা গুরুত্ব দিতো না। বর্তমানে ফ্যাটি লিভারের সমস্যা অন্যান্য কিছু সাধারণ সমস্যা বা সংক্রমণের কারণে (যেমন- বর্তমানে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব) অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করছে।

লিভার ৫ শতাংশ পর্যন্ত চর্বি দাহ্য করতে পারে। তবে লিভারে যদি ৫ শতাংশের বেশি চর্বি জমে থাকে, তবে এটা ধীরে ধীরে ফ্যাটি লিভারে রূপান্তর হয়। এই লিভারের চর্বি জমার কারণে যখন লিভারের কার্যক্ষমতা কিছুটা নষ্ট করে দেয়, তখন লিভারে এনজাইমগুলোর পরিমান বৃদ্ধি পায়।

ফ্যাটি লিভারের এই কার্যক্ষমতা নষ্ট হওয়ার ফলে যে লক্ষণগুলো দেখা যায়, সেগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে অবহেলা করার করাণে মানুষটি ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে।

আরও পড়ুন-

ফ্যাটি লিভারের কারণ

সাধারণত ৫টি কারণে একজন মানুষ ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হতে পারে।

অতিরিক্ত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া

অতিরিক্ত পুষ্টিকর খাবার খেলে ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই পরিমিত খাবার খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হবার ভয়ে প্রয়োজনের তুলনায় কম খাবার খাওয়া যাবে না।

হাইপারলিপিডেমিয়া

হাইপারলিপিডেমিয়া বা রক্তে উচ্চ কোলেস্টেরল। যেসব খাবার খেলে রক্তের কোলেস্টেরল বাড়ে, সেসব খাবার লিভারের ওপর চাপ তৈরি করে। পরিণামে লিভারে চর্বি জমে এবং ফ্যাটি লিভারের লক্ষণ দেখা দেয়।

স্থূলতা

নিঃসন্দেহে ফ্যাটি লিভারের সাথে স্থূলতার সম্পর্ক আছে। যারা মোটা মানুষ, তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশির ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

মদ্যপান

মদ্যপানকে বহু রোগের কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। অ্যালকোহল বা অত্যধিক মদ্যপানের কারণে এবং নন-অ্যালকোহলিক (অ-মদঘটিত) ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (এনএএফএলডি) যা লিভারে চর্বির স্তুপ গড়ে ওঠার কারণ ঘটায়। অতিরিক্ত মদ্যপান করলে ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা বাড়ে।

ডায়াবিটিস

ডায়াবিটিসে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে গ্লুকোজ ও ফ্যাটি অ্যাসিড সুষ্ঠুভাবে পোষণ করতে পারে না। পোষণ না করতে পারার কারণে এই ফ্যাটি এসিড ও গ্লুকোজ লিভারে চর্বি হিসেবে জমা হয় এবং তারা ফ্যাটি লিভার রোগের সৃষ্টি করে।

পাশাপাশি, বিভিন্ন মেডিসিনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া, খুব দ্রুত ওজন কমানো, বেশি পরিমাণ রিফাইন্ড শর্করা গ্রহণ, জেনেটিক্স কারণ, প্রভৃতি কারণে একজন মানুষ ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হতে পারেন।

ফ্যাটি লিভারের লক্ষণ

১। নখ বা চোখ হলদেটে লাগলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে লিভার ফাংশন টেস্ট করিয়ে নিতে হবে।
২। লিভারে চর্বি জমলে স্বাভাবিক কাজ কিছুটা ব্যাহত হয়। খাওয়ার ইচ্ছে কমে যায়। খাবারে অরুচি হয়। দ্রুত ওজন কমা, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, খুব দুর্বল লাগা ও কোনো কাজ করতে ইচ্ছে করে না।
৩। ফ্যাটি লিভারের সব থেকে বড় লক্ষণ স্বাভাবিকের থেকে বেশি কোমরের মাপ বা মোদ্দা কথা ভুঁড়ি। স্থূল ব্যক্তি, বিশেষত যাদের শরীর একটু মোটা; ফ্যাটি লিভারের সমস্যা তাদের সাথে সবচেয়ে বেশী সম্পৃক্ত।
৪। ফ্যাটি লিভার হলে মাথাব্যথা, মন খারাপ ও ডিপ্রেশন, আচমকা কাঁপুনিসহ নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
৬। হজমের সমস্যা ও অ্যাসিডিটি সমস্যা হতে পারে।
৭। অপরিমিত মদ্যপান করলে লিভারের অসুখের ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়া যক্ষার ওষুধ, হরমনের ওষুধ, কিছু ব্যথার ওষুধসহ কয়েকটি অ্যান্টিবায়োটিকে লিভারের কর্মক্ষমতা কমে যেতে পারে।
কিছু কিছু রোগীর লিভার এনজাইমগুলো সরাসরি কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ নিয়ে আসে না।

ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তির উপায়

১। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা। ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে ওজন কমানো সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। যাদের ওজন বেশি, তারা যদি মাত্র ৭-১০% ওজন কমাতে পারেন তবে ফ্যাটি লিভার থেকে খুব দ্রুতই মুক্তি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
২। পানিঃ যকৃত বা লিভার ভালো রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে পানি পান করা। লিভার ভালো রাখতে অবশ্যই সঠিক পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করা আবশ্যক। সুতরাং, অস্বাস্থ্যকর পানীয় যেমন- কার্বোনেটেড বেভারেজ বা রাস্তার মোড়ে থাকা শরবত পানের অভ্যাস থাকলে আজ থেকে বাদ দিন। বিশুদ্ধ পানি পান করে আপনার যকৃতকে সব ধরণের পানিবাহিত রোগ-জীবাণুদের সংক্রমণ থেকে ভালো রাখার চেষ্টা করুন।
৩। খাদ্যভাসে পরিবর্তন আনা এবং ডায়াবেটিস ও লিপিড নিয়ন্ত্রণে রাখে। অতিরিক্ত উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠা এড়িয়ে চলুন।
৪। জীবনে চলার পথে আমরা প্রতিনিয়ত নানা কারণে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় ভুগি। এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অতিরিক্ত উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে ফ্যাটি লিভারের রোগীদের জন্য এটা মারাত্মক। তাই উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা এড়িয়ে চলুন।

দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ বা উত্কণ্ঠিত হয়ে কোনো লাভ নেই। বরং এতে ক্ষতির মাত্রাই বৃদ্ধি পায়। তাই জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করুন। যা ঘটে গেছে তা নিয়ে উদ্বেগাকূল না হয়ে ভবিষ্যতের কথা ভাবুন। আর এই ভাবার কাজটি করতে গিয়ে অযথা টেনশন করবেন না।

মনে রাখবেন, চিন্তা আর দুঃশ্চিন্তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। চিন্তা মানুষকে সামনে এগিয়ে দেয়, আর দুশ্চিন্তা টানে পেছনের দিকে। অতএব উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা-দুশ্চিন্তাকে ‘না’ বলুন।

ফ্যাটি লিভার হলে কিভাবে ডায়েট কন্ট্রোল করবেন?

১। সবুজ শাক-সবজি

পালংশাক, কচুশাক, বিদেশি সবজি ব্রাসেল স্প্রাউট এগুলোও উপকারী ভূমিকা পালন করে। এইগুলো লিভারে ফ্যাট জমতে বাধা দেয়।

২। সয়াবিন

সয়াবিন থেকে তৈরি টফু লিভারের চর্বি কমাতে সহায়তা করে। টফু একটি লো ফ্যাট ও হাই প্রোটিন খাবার।

৩। লো ফ্যাট দুধের তৈরি খাবার

লো ফ্যাট দুধ ও দুধের তৈরি খাবার লিভারের ড্যামেজ থেকে রক্ষা করে।

৪। রসুন

রসুনের গুঁড়া বা পাউডার শরীরের ওজন কমাতে সহায়তা করে।

৫। গ্রিন টি

এই উপকারি চা লিভারে ফ্যাট জমতে দেয় না এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে।

নিয়মিত স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর খাবার সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করলে ডায়াবেটিস, ওজন নিয়ন্ত্রণ বা লিপিড প্রোফাইল ঠিক রাখা কোনো কঠিন বিষয় নয়। আর ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে এই কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারলে লিভার থেকে ফ্যাট খুব সহজে দূর হবে।

লিভার ভালো রাখতে ফিট থাকার কোনো বিকল্প নেই। তবে কোনভাবেই না খেয়ে বা কোনো মেডিসিনের মাধ্যমে খুব দ্রুত ওজন কমানোর চেষ্টা করবেন না। এতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি।

প্রয়োজন মনে হলে পড়ে দেখতে পারেন-

Leave a Comment