সামগ্রিক দৃষ্টিতে টুইটার, লিংকডইন, ফেসবুকসহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে একই ক্যাটাগরিতে ফেললেও এদের মাঝে বৈশিষ্ট্যগতভাবে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। ফেসবুকে মার্কেটিং করে টাকা আয় শুরু করার আগে প্রথমেই ফেসবুকের সব ফিচার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা প্রয়োজন।
পাশাপাশি এটাও জানা প্রয়োজন যে, ফেসবুক অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো হতে কেন ভিন্ন। অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ফেসবুকের মধ্যকার পার্থক্য বুঝতে পারলে ফেসবুক মার্কেটিং করে টাকা আয় করা সহজ একটা কাজে পরিণত হয়।
ফেসবুকে মার্কেটিং শুরু করতে চাইলে কিংবা এর ব্যাপারে জানার আগ্রহ থাকলে নড়ে-চড়ে বসতে পারেন। কারণ এই আর্টিকেলে ফেসবুক মার্কেটিং করে টাকা আয় করার জন্য জরুরী বেশ কিছু টিপস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
ফেসবুক মার্কেটিং শুরু করার আগে করণীয় কি?
ফেসবুকে মার্কেটিং শুরু করার বা পণ্য প্রোমোট করার প্রথম ধাপ হলো একটা ফেসবুক পেজ তৈরি করা। আপনার কোম্পানী, পণ্য কিংবা আপনার নামে প্রথমেই একটা ফেসবুক পেজ তৈরি করে ফেলুন।
এক্ষেত্রে একটা কথা না বললেই নয়, পুরাতন কোনো পেজে বেশি লাইক আছে সে কারণে সেটার নাম পরিবর্তন করে ব্যবহার করবেন না। কারন এক্ষেত্রে পেইজের URL Link সহ অনেক কিছুই পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না এবং বেশি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমস্যা হবে।
শুধু ফেসবুক পেজ তৈরি করলেই হবে না, সেটাকে দিতে হবে আকর্ষণীয় রূপ। ফেসবুক পেজ তৈরীর পর মানুষকে আকৃষ্ট করতে নিচের কাজগুলো করুন।
সুন্দরভাবে এডিট করা একটা প্রোফাইল ফটো এবং কভার ফটো যোগ করুন।
পেজের URL Link আপনার মার্কেটিং এর বিষয়বস্তুর সাথে মিল রেখে সেট করুন।
পেইজের URL Link যত ছোট হবে, ততই ভালো।
Description বক্সে আপনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আকারে কিছু লিখুন।
রিভিউ সিস্টেম অন করে দিন।
আপনার পণ্যটি মানুষের কাছে একঘেয়ে করে তুলবেন না
মানুষ কারো বিজ্ঞাপন কিংবা কোনো পণ্যের প্রোমোটিং দেখতে কিন্তু ফেসবুকে আসে না। তারা ফেসবুকে আসে বন্ধুদের সাথে কথা বলতে, বন্ধুদের আপলোড করা সব ফটো কিংবা ভিডিও দেখতে।
কোনো মার্কেটার যদি সবসময়ই নিরবচ্ছিন্নভাবে ‘এই পণ্যটি কিনুন’ ‘এই ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন’ টাইপ স্টাটাস দিতে থাকে, স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষ এতে বিরক্ত হবে এবং সেভাবে ওই স্ট্যাটাস গুলোর দিকে নজর দেবে না।
তাই সারাদিন একই কথা বার বার বলার মাধ্যমে পণ্য প্রোমোট করলে খুব বেশি লাভের মুখ দেখা যায় না। এর চেয়ে বরং ফেসবুকে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে ব্যবহারকারীদের আস্থা অর্জন করার চেষ্টা করুন। এতে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব।
এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে, কি কি উপায়ে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের আস্থা অর্জন করা যায়?
সহজ উত্তর–
সবসময় সরাসরিভাবে পণ্য বিক্রির চেষ্টা বন্ধ করুন। মানে, সব সময় ‘এই পণ্যটি কিনুন’ টাইপের কথা না বলে ‘এই পণ্যটি কেন কিনবেন’ টাইপের কথাও জানিয়ে দিন।
মানুষকে আপনার করা পোস্টে কমেন্ট করার সুযোগ করে দিন।
সকলের ম্যাসেজ ও কমেন্টের উত্তর দিন।
উত্তরটি অবশ্যই মার্জিত এবং বর্ণনামূলক হতে হবে৷ এক কথায় উত্তর দেবেন না।
কথার সাথে কথা জুড়ে দিন।
কারো কোনো সমস্যার কথা জানালে উত্তরের মাঝে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিন।
কোনো গ্রুপ বা পেজে আপনার পণ্যের সাথে মিল আছে এমন টপিকে আলোচনা করতে দেখলে আলোচনায় অংশ নিন। স্বাভাবিকভাবে কথা শুরুর কিছুক্ষণ পর কৌশলে আপনার পণ্যের কথা জানিয়ে দিন।
নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করা এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজানো
যেকোনো কাজের জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং পরিকল্পনা থাকা অত্যন্ত জরুরী। তবে ফেসবুক মার্কেটিং করে টাকা আয় করার ক্ষেত্রে এই দুইটি জিনিস আরো বেশি জরুরী।
ফেসবুকে মার্কেটিং শুরুর আগেই ভেবে নিতে হয়, কি পরিমাণ টাকা আপনি ফেসবুক মার্কেটিং করে আয় করার আশা করছেন। এবং এর জন্য আপনাকে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
আশা করার ক্ষেত্রে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। প্রথমেই বিশাল কিছু ভেবে ফেললে পরে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
উদাহরণস্বরুপ, মনে করুন আপনি একজন সাধারণ দোকানদার। দোকানের ক্রেতা বাড়ানোই আপনার ফেসবুক মার্কেটিংয়ের মুল উদ্দেশ্য।
আপনি আশা করলেন, ফেসবুক মার্কেটিং করে এর মাধ্যমে আগামী এক মাসে দোকানের বিক্রি ৬০% বাড়িয়ে ফেলবেন।
এমন আশা করলে আপনাকে হতাশ হতেই হবে। কারন, প্রথম মাসেই এতো বড় সফলতা অর্জন করা সহজ কাজ নয়।
আশা করা এবং পরিকল্পনা করার একটি আদর্শ উদাহরণ হতে পারে অনেকটা এমন–
মনে করুন, আপনি একজন সাধারণ দোকানদার, সেক্ষেত্রে ফেসবুক মার্কেটিং করার বেলায় বাস্তবতার সাথে মিল রেখে একটা উদ্দেশ্য ঠিক করা (যেমনঃ আগামী ছয় মাসে বিক্রির মাত্রা ৪০% পর্যন্ত বাড়ানো)।
প্রতিদিন বিভিন্ন পণ্যের ছবি এবং তার সম্পর্কে আকর্ষণীয় কিছু লিখে প্রকাশ করা।
ক্রেতারা আপনার দোকান থেকে পণ্য কিনে কতটা খুশি, তা ছবির মাধ্যমে তুলে ধরা।
আপনার দোকান থেকে পণ্য কেনার পর ফেসবুক পেইজে এর সম্পর্কে রেটিং দেয়ার জন্য ক্রেতাদের উৎসাহিত করা।
বিক্রির ক্ষেত্রে সত্যিই ফেসবুক মার্কেটিং ভূমিকা রাখছে কিনা যাচাই করতে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন কুপন দেয়া।
ফেসবুক মার্কেটিং করে টাকা আয় করার জন্য নিয়মিত স্ট্যাটাস দিন
ফেসবুক মার্কেটিং করার সময় একজন মার্কেটারের মূল লক্ষ্য থাকে নিজস্ব ফেসবুক পেজ বা অন্য উপায়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। আর ফেসবুকে দৃষ্টি আকর্ষণের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো ‘স্ট্যাটাস বা পোস্ট’।
ভারতীয়দের উপর চালানো এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে যে, ফেসবুক ব্যবহারকারীরা গড় হিসেবে দিনে এক ঘন্টা ফেসবুকে ব্যয় করে। আর এই এক ঘন্টার মাঝে অর্ধেকের বেশি সময়ই তারা কাটায় টাইমলাইন স্ক্রল করতে গিয়ে।
তাই, তাদের টাইমলাইনে প্রতিনিয়ত আপনার পণ্যের ছোঁয়া রাখার চেষ্টা করুন। নিয়মিত পোস্ট করুন। অবশ্যই পোস্টের ধরণে বৈচিত্র্য রাখতে হবে। নয়তো ব্যবহারকারীরা ‘unfollow’ করতে কিন্তু খুব বেশি সময় নিবে না।
আপনি নিজে সুন্দর করে সাঁজিয়ে গুছিয়ে পোস্ট করতে না পারলে দক্ষ কাউকে ভাড়া করতে পারেন।
স্ট্যাটাসের ব্যাপারে অবশ্যই মনে রাখবেন–
একটি পণ্য সম্পর্কে মাত্র একটি পোস্ট করেই ক্ষ্যান্ত হওয়া যাবে না৷ ভিন্ন ভাবে ওই একই পণ্য নিয়ে কিছুদিন পর আবার পোস্ট করতে হবে।
স্ট্যাটাস বা পোস্টের সাথে আকর্ষণীয় এবং প্রাসঙ্গিক ছবি যুক্ত করতে ভুলবেন না যেন। এতে অনেকে ছবিতে আকৃষ্ট হয়েই হয়তো স্ট্যাটাসটি পড়তে শুরু করবে।
দৈনিক খুব বেশি পোস্ট করবেন না। মার্কেটিং এর জন্য দিনে সর্বনিম্ন ১ বার পোস্ট করা ভালো। সর্বোচ্চ ৫ বারের বেশি স্ট্যাটাস দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
ছবি পোস্ট করলে অবশ্যই নিজস্ব কোম্পানী বা স্বকীয়তার নিদর্শন জুড়ে দিতে হবে।
মনে করুন, আপনার পণ্যের একটি ছবি ফেসবুক পেজে পোস্ট করলেন। প্রচুর ভিজিটর সেটি পছন্দ করল এবং ছবিটি ডাউনলোড করে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করল।
সেই বন্ধুদের মাঝে কারো যদি সেটি ভালো লেগে যায়, তাহলে সে আপনার সাথে সহজেই যোগাযোগ করবে কিভাবে?
সে অবশ্যই প্রথমে দেখবে ছবিতে বিক্রেতার কোনো ওয়াটারমার্ক আছে কিনা।
তাই ছবিতে আপনার কোম্পানি বা আপনার পরিচয় যুক্ত করে দিন কিংবা এমন চিহ্ন যুক্ত করুন, যেন যে কেউ সহজেই আপনাকে খুঁজে পেতে পারে।
বিভিন্ন পণ্যে মাঝে মাঝেই ছাড় দিন
ছাড় কে না পছন্দ করে? সামান্য ‘ছাড়’ বা ‘ডিসকাউন্ট’ শব্দই যে কোনো মানুষের দৃষ্টি আঁটকে দিতে যথেষ্ট।
বড় বড় কোম্পানি মাঝে মাঝেই নিজেদের বিশেষ বিশেষ পণ্যে ছাড় দিয়ে থাকে। মানুষ ১৫০ টাকার পণ্য না কিনে ২০০ টাকার পণ্য ৫০ টাকা ছাড়ে কিনতেই বেশি পছন্দ করে। আর পছন্দ করবেই না বা কেন?
দামে সস্তা, বাজারের সেরা জিনিস কে না ভালোবাসে!
তাই মাঝে মাঝেই পণ্যের উপর ছাড় দিন। সরাসরি ছাড় না দিয়ে শর্ত জুড়েও ছাড় দিতে পারেন।
উদাহরণ স্বরুপ–
মাঝে মাঝে বিভিন্ন কন্টেস্ট নিতে পারেন। বিজয়ীরা পুরষ্কারস্বরুপ পাবে দুর্দান্ত কোনো ছাড়!
কুইজ করতে পারেন।
আপনার পোস্ট শেয়ার করে ছড়িয়ে দেয়ার বিনিময়েও ছাড় দিতে পারেন।
আপনার ফেসবুক পেজটি প্রোমোট করুন
খুবই দুঃখের কথা হলো, ফেসবুকের অ্যালগরিদম অনুসারে সাধারণ পেইজগুলো দ্বারা করা পোস্ট মোট ফলোয়ারের মাত্র ৫০-৬০ ভাগ কিংবা তারচেয়েও কম লোকের টাইমলাইনেই পৌছায়।
তাই আপনার পণ্য আরো বেশি লোকের কাছে পৌছে দিতে পেইজটি প্রোমোট করে নিন।
ফেসবুকের ক্ষেত্রে পেজ প্রোমোট করার পদ্ধতি খুব সহজ এবং সাধারণ। প্রোমোটিং করার সময়ই পেইজটি কোন বয়সের, কোন অঞ্চলের কিংবা কোন জেন্ডারের মানুষের কাছে পৌছাতে হবে, তা নির্ধারণ করে দেয়া যায়।
যদি পেজ প্রোমোট করার মতো আর্থিক অবস্থা না থাকে, তবে অন্য পথ বাছাই করুন।
আপনার এবং আপনার বন্ধুদের ফ্রেন্ডলিস্টের সবাইকে পেজটিতে লাইক দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। পেজের মধ্যে গেলেই আমন্ত্রণ জানানোর (Invite Friends) অপশন পেয়ে যাবেন।
এছাড়াও –
আপনার বিজনেস কার্ড, ওয়েবসাইট ও ফেসবুক প্রোফাইলে পেজের লিংক যুক্ত করুন।
ইমেইলের স্বাক্ষরে ফেসবুক পেইজের লিংক দিন।
বিভিন্ন গ্রুপে পণ্যের বর্ণনা ও পেইজের লিংক দিয়ে ভালো কিছু লিখুন।
— পরিশেষে —
ফেসবুক মার্কেটিং করে টাকা আয় করতে গেলে ধৈর্যের কোনো বিকল্প নেই। ব্যবহারকারীদের নজরে পড়তে অনেকটা সময় লেগে যেতে পারে। আর শুধু নজরে পড়লেই তো হবে না, অর্জন করতে হবে তাদের আস্থাও।
এ সব কিছু হতে মোটামুটি একটা ভালো সময় লেগে যাবে। তাই ধৈর্য্য রাখতে হবে।
কোনোকিছুই হুট করে হয়ে যাবে না। হবে পদে পদে, আস্তে আস্তে।
প্রাসঙ্গিক লেখাসমূহ পড়ে দেখতে পারেন-