সারাদিন পড়ছেন? প্রচুর পড়ছেন? নাওয়া-খাওয়া সিঁকেই তুলে পড়ছেন; তবুও পড়াশোনাকে মগজে গাঁথতে পাড়ছেন না? পড়া মনে রাখার উপায় খুঁজে চলেছেন অবিরত? কিন্তু খুঁজে পাচ্ছেন না? তাহলে আর দেরি না করে ঝটপট পড়ে ফেলুন এই লিখাটি এবং নির্দেশনাগুলো পানির সাথে গুলিয়ে খেয়ে ফেলুন। পড়া মনে থাকতে বাধ্য!
পরিপাটি হয়ে পড়তে বসুন
- পড়ার টেবিলে বসার আগে যদি একটু ফ্রেশ হয়ে নেন, মনকে চাঙ্গা হয়ে নেন, তাহলে এটা আপনার পড়াশুনাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করবে।
- চুলটা উসকো-খুসকো, এলোমেলো থাকলে আঁচড়িয়ে নিবেন।
- পড়ার কক্ষকে অবশ্যই পরিচ্ছন্ন রাখবেন। কাগজের টুকরা, চিপস্ এর প্যাকেট, কলার খোসা বা অন্যান্য আবর্জনাদি যত্রতত্র ফেলে রুম নোংরা করে রাখবেন না।
- তরল জাতীয় পদার্থ বই / খাতা / নোটের অতি নিকটে রাখবেন না।
- পড়তে বসার আগে হাতঘড়ি বা টেবিল ক্লক সাথে নিয়েই বসবেন।
- প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নিয়েই পড়ার টেবিলে যাবেন যাতে বারবার উঠতে না হয়। বারংবার ওঠাবসা মনঃসংযোগকে বিঘ্নিত করে।
- পড়াশুনার জন্য শান্ত/নিরিবিলি জায়গা বেছে নিন যাতে আপনার মনোযোগ পুরোদমে পড়ার দিকে থাকে।
এভাবে পরিপাটি হয়ে সবদিক দেখে-শুনে নিয়ে পড়তে বসলে পড়ায় মনযোগ আসবে। এসব কিছু পড়া মনে রাখার এবং ধরে রাখার অন্যতম উপায়।
আরও পড়ুন –
মনকে পড়ার দিকে কেন্দ্রীভূত করুন
বাজে চিন্তা বাদ দিয়ে একাগ্রচিত্তে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। গত দিন কি ঘটে গেছে বা ক্ষণিক আগে কি ঘটে গেল সেসব নিয়ে চিন্তা করে কপালের ভাজ বাড়ানো নিতান্তই বোকামি।
‘আমাকে এখন পড়ায় মনোনিবেশ করতেই হবে’- এই ধ্যান ধারণা মাথায় নিয়ে সবচেয়ে সহজ সাবজেক্টটি দিয়ে পড়া শুরু করুন। পড়াকে আনন্দের বিষয়ে পরিণত করতে না পারলে আপনি শিক্ষার অকৃত্রিম স্বাদ বুঝবেন না।
শিক্ষা যে কত মজার, কত আনন্দের একটা বিষয় তা উপলব্ধি করতে পারলে আপনার মন আপনা আপনি পড়ার টেবিলের দিকে ঝুঁকে পড়বে।
মনকে পড়াশুনা মুখী করতে হলে বিভিন্ন মজাদার এক্সপেরিমেন্ট করতে পারেন হাতের নাগালে পাওয়া জিনিসগুলো দিয়েই। কেননা, এক্সপেরিমেন্ট করতে হলে জানতে হয় আর তার জন্য পড়তে হয়।
আর মন একবার পড়াশুনার মধ্যে ঢুকে গেলে আপনি যেটাই পড়ুন না কেন তা মনে থাকবে ভালো।
প্রথমেই গত দিনের পড়া চোখ বুলিয়ে নিন
হ্যাঁ, আপনি তো পড়ার টেবিলে বসে গেছেন কিন্তু পড়া শুরু করলেন একদম নতুন পাঠ দিয়ে। নতুন পড়া দিয়ে শুরু করতে গেলে অনেকসময় যেটা হয় অনেকেই পড়ার আগাগোড়া কিছুই বোঝে না। ফলে পড়ার আগ্রহটি কমে যায়, হাল ছেড়ে দেয়।
এ সমস্যা দূরীকরণে আপনাকে প্রাসঙ্গিক পূর্বদিনের পাঠগুলোতেও একবার চোখ বোলাতে হবে। এতে আপনার পুরো বিষয় সম্পর্কে সমৃদ্ধ ধারণা আসবে। আপনি পাঠটি সহজেই বুঝতে পারবেন, অতিরিক্ত ঘাম ঝরাতে হবে না। সেই সাথে পাঠের ওপর ভালো দখল আনতে পারবেন।
রুটিন অনুযায়ী পড়ুন
টেবিলের সামনের দেয়ালে একটি রুটিন সেঁটে দিন। কিন্তু শুধু সেঁটে দিলেই তো চলবে না, সেটা মানতে হবে পুরোপুরিভাবে। রুটিনটি আপনার সুবিধামতো তৈরী করুন যাতে তা মানতে গেলে আপনাকে ধকল পোহাতে না হয়।
প্রতিটি সাবজেক্টের জন্য এক ঘণ্টা বরাদ্দ করতে পারেন। হ্যাঁ, জটিল সাবজেক্ট হলে সময় বাড়াতে হবে। রুটিন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিদিন পড়তে বসুন। আপনি যখন সবচেয়ে বেশি এনারজেটিক ফিল করবেন তখন কঠিন সাবজেক্টগুলোতে হাত দিন।
সাধারণত ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর মস্তিষ্ক সতেজ থাকে। ওই সময়টাতে উঠে পড়ার চেষ্টা করুন।
বিরতি দিয়ে পড়ুন
একটি গবেষণায় দেখা গেছে পড়ার ঠিক চারঘণ্টা পর ব্যায়াম বা শরীরচর্চা মস্তিষ্ককে চাঙ্গা করে। ডাচ বিজ্ঞানীরা বাহাত্তর জনের উপর পরীক্ষা চালিয়ে এ তথ্যটি প্রকাশ করেছেন। কেননা, শরীরচর্চার ফলে শরীর থেকে যে প্রোটিন নির্গত হয় তা মস্তিষ্কের স্মৃতি ধারণক্ষমতাকে জোরালো করে।
তাই পড়ার মাঝে বিরতি দিন একনাগাড়ে না পরে। সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর বিরতি দিয়ে হালকা কিছু খেতে পারেন। আর চার ঘণ্টা পর করুন শরীরচর্চা।
পড়ার মাঝে ঝিমুনি বা ঘুমঘুম ভাব আসলে উঠে গিয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে আসুন।এভাবে বিরতি দিয়ে দিয়ে পড়লে আপনার ব্রেইনের ধারণক্ষমতা বাড়বে।
ট্যাব/স্মার্টফোন/ল্যাপটপে বিস্তারিত জানুন
একজন জ্ঞানপিপাসু মানুষ সবসময় জ্ঞানের ভাণ্ডারের পেছনে ছোটে। স্বল্পজ্ঞান তার আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে না। আপনিও যদি এমন হন যে, পড়তে গিয়ে আপনার মনে হয়, ‘ইশ! যদি আরেকটু জানতে পারতাম!’
আবার আপনার শখ জ্ঞান আহরণ করা কিন্তু সমস্যা হলো সেই জ্ঞানকে ধারণ করতে পারছেন না। তাহলে উভয় সমস্যাকে সমাধিস্থ করতে ইন্টারনেটে ঢুঁ মারুন। এতে বিশদ ও বিস্তারিতভাবে জানার ফলে পাঠের বিষয়টি আপনার কাছে সাবলীল হয়ে যাবে।
ই-বুক পড়তে পারেন। এতে অডিও/ভিডিও/এনিমেশন ইত্যাদি নানা ফিল্ড যুক্ত থাকে। ফলে আপনি একটি চমকপ্রদ পাঠ উপভোগ করতে পারবেন।
অডিও/ভিডিও শ্রবণ ও দর্শনের সময় চোখ, কান দুটোই সক্রিয় থাকে বলে আপনার মস্তিষ্ক অযুগ্ণতার সহিত ডেটা এন্ট্রি করতে পারবে।
এসবকিছু পড়া মনে রাখার উপায় হিসেবে খুবই ফলপ্রসূ।
সময় ধরে পড়ুন
হ্যাঁ, আপনাকে পড়ার মাঝে মাঝে বিরতি দিতে হবে ঠিকই কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত বিরতি নয়। আপনি যে সাবজেক্টের জন্য যে সময়টুকু বরাদ্দ দিয়েছেন সে সময়টুকুকে কাজে লাগান।
পড়তে পড়তে হঠাৎ উঠে যাবেন না, সাবজেক্টটি শেষ করে উঠুন বা অন্য কাজ করুন। আর পড়ার মাঝে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সক্রিয় থাকলে চলবে না। বা প্রয়োজন ব্যতীত বার বার মোবাইলে হাত দিলে চলবে না। কেননা, এটি ধীরে ধীরে আপনার মনযোগকে ধ্বংস করে দিবে।
যে সাবজেক্টগুলোতে আপনি অপক্ব বা কঠিন লাগে সেগুলো দু’বেলা সময় ধরে পড়ুন। প্রয়োজনে গ্রুপ স্টাডি করতে পারেন। গ্রুপ স্টাডির ফলে আপনি আপনার শেখার বিষয়টিকে আপনার বন্ধুদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও দেখতে পারবেন।
না বুঝে মুখস্থ নয়
ভাত না চিবিয়ে গলাধঃকরণ করলে কেমন লাগে? প্রশান্তি পান? ঠিক তেমনি না বুঝে মুখস্থ করলে আপনি প্রশান্তি পাবেন না। সেই না বুঝে মুখস্থ করা পড়া ভুলে যাওয়ার ভয় আপনার মাথায় সবসময় জেঁকে বসবে। তাই সবার প্রথমে আপনার পড়াটিকে ভালোভাবে বুঝুন।
যেগুলো মনে রাখা একান্তই জরুরি- যেমন টুকরো তথ্য (জন্ম সাল, মৃত্যু সাল, যুদ্ধ সাল ইত্যাদি) সেগুলো মুখস্থ করুন। আপনি যদি পাঠের কনসেপ্ট সম্বন্ধে ক্লিয়ার হয়ে যান তবে আপনি নিজে থেকেই লিখতে পারবেন।
অনেককে গণিতের মতো বিষয়টিকেও মুখস্থ করতে দেখা যায়। ফলস্বরুপ কি হয়? এক অঙ্কের মান ভুলবশত অন্য অঙ্কে বসিয়ে শেষমেশ পরীক্ষার খাতায় আসে বিগ জিরো।
এসব জিরো লেভেলের আইডিয়া বাদ দিয়ে আগে বুঝতে চেষ্টা করুন। কিছু কিছু বিষয়কে গল্পের মতো করেও মনে রাখা যেতে পারে। কেননা, কয়েক লাইন পড়া মনে রাখার চেয়ে গল্প মনে রাখার উপায়টি অনেক বেশি সহজ।
পড়ার সাথে লিখার অভ্যাস রাখুন
পড়ার সাথে সাথে আপনাকে লিখার অভ্যাসও তৈরি করতে হবে। কেননা, কোনো টপিক পড়ার তুলনায় লিখে রাখলে তা আমাদের মেমোরিতে স্থায়িত্ব লাভ করে বেশি। পাশাপাশি লিখার অভ্যাস রাখলে ভুল বানান শুধরে নেওয়া যায় দ্রুত।
এছাড়া লিখার পর আপনি নিজেই চেক করলে ভুল-ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করতে পারবেন এবং সংশোধিত হতে পারবেন। তবে সব পড়াই লিখে রাখা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই যে উত্তরগুলো একটু প্যাঁচানো, জটিল মনে হয় সেগুলো লিখুন।
বারবার লিখুন নির্ভুল না হওয়া পর্যন্ত। এটি যেমন আপনার লেখার গতি বাড়াবে তেমনি লেখাকেও করে তুলবে ঝকঝকে সুন্দর।
নিজেই নোট তৈরী করুন
অন্যের লেখা গাইডের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেই নোট তৈরীতে সচেষ্ট হোন। শিক্ষক যা ক্লাসে বলল তা সংক্ষেপে নোট করুন এবং বাসায় ফিরে বই ঘেঁটে + নিজের চিন্তা-ভাবনা যোগ করে তৈরী করে ফেলুন দুর্দান্ত একটি নোট।
নোটের মেইন পয়েন্টগুলোকে হাইলাইটিং করুন। যাতে পরীক্ষার আগের রাতে স্কিম রিডিং করতে পারেন। আপনার নোটগুলোকে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করুন যাতে তা সহজে বহনযোগ্য হয়। নোট তৈরীর সময় পড়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ চিত্র/ছবি যোগ করুন। নিজের তৈরী নোট নিজের ভাবসত্তাকে প্রকাশ করে। অন্যান্য গাইডের চেয়ে নিজের তৈরী নোটের কনসেপ্ট আপনি ভালোভাবে স্মৃতিগোচর করতে পারবেন।
খাদ্যাভ্যাসে নজর দিন
মস্তিষ্ককে যদি আরও সতেজ করতে চান তবে আপনার খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা একান্ত জরুরী। এটিকে পড়া মনে রাখার অব্যর্থ উপায় হিসেবেও গণনা করতে পারেন।
সবুজ চা বা গ্রিন টি পান করুন। এতে ক্যাফেইনের পরিমাণ কম থাকে। এই পানীয়টি মস্তিষ্কের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত পানীয় হিসেবে বিবেচিত।
গবেষণা থেকে জানা যায়, কফির তুলনায় সবুজ চা পানকারী ব্যক্তির ব্রেইন অধিক বেশি স্থিতিশীল এবং গঠনশীল।
পড়ুন –
ব্লুবেরিকে এন্টিঅক্সিডেন্টের খণি বলা হয়। এক গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি একনাগাড়ে বারো সপ্তাহ ধরে ব্লুবেরির জুস পান করে তবে তার স্মৃতিশক্তির আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে।
ভিটামিন সি আপনার স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। তাই কমলা, লেবু, মাল্টা, আমলকি ইত্যাদি অর্থাৎ ভিটামিন সি এর চাহিদা পূরণ করুন।
স্ট্রবেরি অন্যান্য বেরির মতোই মস্তিষ্কের জন্য কার্যকরী। এটি বয়সের সাথে ক্ষয় হতে থাকা মেমোরি সেলের ক্ষয় হওয়ার মাত্রা হ্রাস করে।
আপনি যদি দিনে কমপক্ষে আটটি স্ট্রবেরি খান তবে আপনার মস্তিষ্কের বিকাশ অনেক দ্রুত এবং প্রখর হবে।
পড়া মনে রাখার বেশ কয়েকটি ইফেক্টিভ উপায় বলেছি। পড়া মনে রাখার এই উপায় গুলো যদি ধৈর্য্য সহকারে পড়ে থাকেন তবে আপনার জীবনে তা কাজে লাগাতে খুব একটা বেগ পোহাতে হবে না বলে আশা করছি।
সর্বোপরি শরীর ভালো রাখুন, সুস্থ্য থাকুন। পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান। অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম শরীরকে দূর্বল করে দেয়। অধিক পরিশ্রমে শরীরকে কাহিল না করে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করুন।
পড়া মনে রাখার জন্য বা উপায় পাওয়ার জন্য কোনো যাদুমন্ত্রের দরকার হয় না। নিজের লাইফস্টাইলে একটু পরিবর্তন আনুন। নিয়ম মেনে চলতে চেষ্টা করুন।
লেখকঃ মাহজাবিন সাবিহা মেধা