প্রতিদিন সকালে করনীয় কিছু কাজ — যা আপনার দিনটিকে করবে আরো মোহনীয়

আপনি কি পারবেন শরতের এক টুকরো রৌদ্র খাঁচায় আঁটকে রাখতে? পারবেন কি চিংড়ি মাছের এক ফোঁটা রক্ত সংগ্রহ করতে? জানি, পারবেন না! কারণ এগুলো অসম্ভব। তেমনি প্রত্যহ সকালে করনীয় এমন কিছু বিষয় আছে যা না করলে আপনার পক্ষে সমস্ত দিন ভালোভাবে কাটানো অসম্ভব।

চলুন জেনে নেয়া যাক, প্রত্যহ সকালে করনীয় এমন কিছু বিষয় সম্পর্কে, যা আপনার সমস্ত দিনটি ভালোভাবে কাটাতে সাহায্য করবে।

জেগে উঠুন সকাল সকাল!

আপনার সমস্ত দিন ভালোভাবে কাটাতে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠবার বিকল্প আর কি আছে?

আপনি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলে কাজের জন্য যেমন যথেষ্ট সময় পাবেন, তেমনি, স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আপনার কাজের তাড়া কমে যাবে। যা আপনাকে মুক্তি দিবে মানসিক চাপ থেকে।

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক জানিয়েছেন ‘যারা সকালে ঘুম থেকে উঠেন, তারা দেরিতে ঘুম থেকে উঠা শিক্ষার্থীদের তুলনায় ভালো ফলাফল করেন’।

আরো এক গবেষণায় দেখা গেছে, ‘যাদের ভোরে ঘুম ভাঙে, তারা বেশ সুখি থাকেন। আর এই সুখ সল্পমেয়াদী নয়, বরং সারাটা জীবন ধরেই এই সুখের ছোঁয়া বিদ্যমান থাকে।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠবার যে কতো উপকারিতা তা লিখে বোঝানো প্রায় অসম্ভব।

কিন্তু এত-শত উপকারিতার মাঝেও সবচেয়ে কমন প্রশ্ন হল, ‘সকালে উঠবো কিভাবে?’ সকালে উঠা খুব বেশি কষ্টকর হবেনা যদি আপনার রাতের ঘুমটি ভালো হয়।

এজন্য প্রথমেই আপনাকে ভালো ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

কিন্তু হাস্যকর হলেও সত্যি যে অনেকেই বলে থাকেন, ভাল ঘুমের অভ্যাসগুলি সাধারন জ্ঞানের মত।

সত্যিই তাই!

তবে এগুলোকে অনুশীলন করতে প্রতিশ্রুতিবধ্য ও দৃঢ় পরিকল্পনা করা অতীব জরুরি।

চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক-

ভাল ঘুমের জন্য প্রয়োজনীয় টুকিটাকি কিছু তথ্য

শোবার পূর্বে ঢিলেঢালা ও আরামদায়ক পোশাক পড়ে নিন।

ল্যাপটপ, মোবাইল ফোনের মতো ইলেক্ট্রনিক্সের ব্যাবহার বন্ধ করে আপনার মস্তিষ্ককে ঘুমের প্রস্তুতি নেবার সুযোগ দিন।

শোবার অন্তত একঘণ্টা পূর্ব পর্যন্ত ভারী খাবার বা অস্বাস্থ্যকর স্ন্যাক্স কিংবা কোল্ড ড্রিঙ্কস পান করা থেকে বিরত থাকুন।

পছন্দ মতো একটি বই পড়ুন।

সারাদিনে ঘটে যাওয়া আপনার সবগুলো আনন্দময় স্মৃতি একে একে মনে করুন।

শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যায়াম চর্চা করুন।

দীর্ঘদিন যারা অনিদ্রায় ভুগছেন তারা শোবার পূর্বে একটু স্নান করে নিলে বেশ উপকৃত হবেন।

কিছুটা শীতল পরিবেশে ঘুমের আয়োজন করুন।

সেইসাথে যতটা সম্ভব আপনার শয়ন কক্ষটিকে অন্ধকার করবার চেষ্টা করুন।

আরামদায়ক বিছানা ব্যবহারে ভালো সুফল পাবেন।

ঘুমানোর জন্য আপনার বিছানাটি ব্যবহার করুন, টেলিভিশন দেখবার জন্য নয়।

আরও পড়ুন –

পানি পান করুন!

সকালে ঘুম থেকে উঠেই খালি পেটে এক থেকে তিন গ্লাস পানি পান করুন।

সামান্য এই অভ্যাসটি যদি রপ্ত করতে পারেন, তাহলে আপনি নিজেকে পানিশুন্যতা, বমি বমি ভাব, গলার সমস্যা, মাসিকের সমস্যা, ডায়রিয়া, কিডনির সমস্যা, গ্যাস্ট্রিক আলসার, পাইলস, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি আরো অনেক জটিল রোগের হাত থেকে বাঁচাতে পারবেন।

ঘুমন্ত অবস্থায় পাক-যন্ত্র প্রায় অবসরেই থাকে, হজম প্রক্রিয়ার তেমন কোন কাজ থাকে না। তাই সকালে ঘুম থেকে উঠে হজম প্রক্রিয়াকে সহায়তা করার জন্য তিন গ্লাস, সম্ভব না হলেও অন্তত এক গ্লাস পানি পান
করুন।

প্রতিদিন যদি আপনি ১৬ আউন্স হালকা গরম পানি পান করেন তাহলে আপনার মেটাবলিসম প্রায় ২৪% বেড়ে যাবে, যা আপনার শরীরের ওজন কমাতে এক সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

এই পানি পানের ফলে আপনার রক্তের সমস্ত দূষিত পদার্থ বের হয়ে যাওয়ায় আপনার ত্বক হয়ে উঠবে আরো সুন্দর ও উজ্জ্বল।

এভাবে প্রতিদিন নিয়ম করে খালি পেটে পানি পান করলে আপনার মলাশয় পরিষ্কার হয়ে
যাবে। যার ফলে আপনার শরীর নতুন করে খাবার থেকে পুষ্টি গ্রহন করতে পারবে খুব সহজেই।

নোটঃ সকালে পানির বদলে খালি পেটে দুধ, চা, জুস কিংবা যেকোন প্রকার কোমল পানীয় পান করা স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাড়াতে পারে। কাজেই এসব পান না করে পানিই পান করা উচিত।

হালকা ব্যায়াম

শরীর সুস্থ্য না রেখেই দিন ভালো কাটানোর চিন্তা করা আকাশ কুসুম ভাবনা ছাড়া আর কি? আপনার দিন তখনই ভালো কাটবে যখন আপনি শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ্য থাকবেন। আর আপনার এইরুপ সুস্থ্যতার জন্য প্রতিদিন সকালে হালকা কিছু ব্যায়াম করাই যথেষ্ট।

সকালের ব্যায়াম বা শরীরচর্চা হল স্বাস্থ্যহীন এবং স্বাস্থ্যবান উভয় শ্রেণির মানুষের জন্য প্রকৃত এনার্জি-বুস্টার বা শক্তি বৃদ্ধিকারী।

প্রতিদিন সকালের নিয়িমিত ব্যায়াম আপনার শরীরে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা ও কার্ডিওভাস্কুলার ফিটনেস বৃদ্ধি করবে, যা আপনার শারীরিক গঠন উন্নত করতে একান্ত জরুরি।

আপনি যখন দিনের শুরুতেই ২০/৩০ মিনিট খোলামেলা মনোরম পরিবেশে জগিং করবেন, তখন আপনার সারাদিনটা ভালো যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে শতভাগ।

কারণ এই ২০/৩০ মিনিটের শরীরচর্চাই মস্তিস্কের হরমোন সেরোটোনিন এবং নারপাইনফ্রাইন সংবেদন্শীলতা বৃদ্ধি করে আপনার বিষণ্ণতার অনুভূতি উপশম করবে।

তখন মন হয়ে উঠবে আরো বেশি সতেজ এবং আরো বেশি উৎফুল্ল।

আবার প্রত্যহ সকালে হাঁটার ব্যাপারটি ‘উচ্চ রক্তচাপ রোধী ঔষধ হিসেবে কাজ করে।

প্রয়োজন মনে হলে পড়ে নিতে পারেন –

চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক,

দিন ভালো কাটাবার মহা ঔষধ স্বরূপ এই ‘হালকা ব্যায়াম’ নামক বিষয়টির টুকিটাকি।

স্ট্রেচিং ব্যায়ামঃ ‘সারারাত একটানা ঘুমানোর পর শরীর যেন আটকে থাকে, সহজে নড়তে পারা যায় না!’ এরকম সমস্যা যদি আপনারও হয়ে থাকে তাহলে সকাল সকাল অফিসে দৌড়াবেন কিভাবে?

এক্ষেত্রে আপনার প্রয়োজন প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই অন্তত ১০ মিনিট এই ব্যায়াম করা।

স্ট্রেচিং বেশ কয়েক ধরনের হয়ে থাকে। যেমনঃ ফ্রন্ট ব্যান্ড, সাইড ব্যান্ড, ক্রাঞ্চ, আর্ম সুইং, হেড সুইং ইত্যাদি।

আপনার শরীরের যেকোন ব্যাথা নিরাময় করতে চাইলে এবং সারাদিন হেঁসে-খেলে, দৌর-ঝাঁপ করে কাঁটাতে চাইলে এখন থেকে প্রতিদিন সকালে স্ত্রেচিং ব্যায়াম করবার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

লেগ রাইজঃ মেদ-ভুরি কে চিরবিদায় জানিয়ে, আপনার দেহকে সুঠাম ও আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে চান?

তাহলে আপনার জন্য প্রতিদিন সকালে লেগ রাইজ করা বাধ্যতামূলক!

প্রতিদিন একটানা ৫ মিনিট লেগ রাইজ করলে আপনার শরীরের অতিরুক্ত চর্বি বার্ন হয়ে আপনি হয়ে উঠবেন আরো স্লিম ও ফিট দেহের অধিকারী।

লেগ রাইজ করার ফলে আপনি আপনার পেট,তলপেট এবং বুকে এক প্রকার টান অনুভব করবেন। আন্ত্রিক মাসালস এর দৃঢ়তার জন্য এমনটি হয়ে থাকে।

হাঁটা বা জগিংঃ ডায়বেটিস আর উচ্চরক্তচাপ যদি বুনো ওল হয় তাহলে প্রত্যহ সকালে হাঁটা হল বাঘা তেঁতুল।

সকাল সকাল ভারি খাবার নয় বরং হালকা কিছু ছোলা এবং ইসবগুলের ভুসি খেয়েই বেড়িয়ে পড়ুন হাটতে। ছোট-বড় যেকোন বয়সের মানুষের জন্য হাঁটা হলো সবচেয়ে সহজ একটি ব্যায়াম।

প্রতিদিন সকালে হাঁটবার অভ্যাস করলে শরীরের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এলডিআর কমে গিয়ে ও ভালো কোলেস্টেরল এইচডিআর এর মাত্রা বেড়ে গিয়ে আপনার স্ট্রোক ও হার্টের অসুখের ঝুঁকি শতকরা ২৭ ভাগ পর্যন্ত কমিয়ে দিবে।

এছাড়াও এটি আপনার হাড় মজবুত এবং ভারসাম্যের উন্নতি সাধন করবে। হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের বিশেষজ্ঞরা সবসময়ই রক্তে চিনির মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে ও স্থুলতার ঝুঁকি কমাতে প্রতিদিন সকালে হাঁটার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

আর খোলামেলা মনোরম পরিবেশে টানা ৩০ মিনিট হাঁটার ফলে আপনি পাবেন মানসিক ভাবে সুস্থ্যতা ও প্রাণবন্ত অনুভূতি। যা আপনার দিনটি ভালোভাবে কাটানোর জন্য একান্ত জরুরী।

নোটঃ খেয়াল রাখবেন হাঁটা বা দৌড়ানোর সময় আপনার শরীরের ভর যেন গোড়ালির উপর না পড়ে, পায়ের পাতার উপর ভর করে দৌড়ানোর অভ্যাস করুন।

আর দৌড়ের গতি কখনই নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাবেন না।

দড়ি লাফঃ আপনার আশেপাশে যদি হাঁটা কিংবা দৌড়ানোর মত উপযুক্ত জায়গা না থাকে তাহলে দড়ি লাফ লাফ হল আপনার জন্য অত্যন্ত কার্যকরী একটি ব্যয়াম যা আপনি অল্প জায়গার মধ্যেই করতে পারবেন।

গণনার দিক দিয়ে হাঁটা বা দৌড়ান এবং দড়ি লাফের উপকারিতা প্রায় সমান। এক্ষেত্রেও নজর রাখতে হবে শরীরের ওজন যেন পায়ের গোড়ালিতে না পড়ে কারণ পায়ের গোড়ালিতে বার বার আঘাত পড়লে হাড়ের এবং মেরুদণ্ডের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

নাস্তা করতেই হবে!

সকাল থেকেই তো আপনার ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। ফলে কাজের তাড়াহুড়ো বা সময়ের অভাবে আপনি হয়তো প্রায় সময়ই সকালের নাস্তা এড়িয়ে যান।

কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন কি দুপুরের খাওয়ার আগ পর্যন্ত আপনার শরীর ঠিক কতটা শক্তি খরচ করে? সকালে নাস্তা না করে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার পর এতটা শক্তি খরচ করলে শরীরের ওপর বেশ ধকল তো যাবেই।

প্রয়োজন হলে জোর করে খান, তবুও সকালের নাস্তা না খেয়ে থাকবেন না। কারণ আপনি যদি নিজেকে একটি চার চাকার মোটর গাড়ির সাথে তুলনা করেন তাহলে সকালের নাস্তাটি হল ইঞ্জিন স্বরূপ অর্থাৎ সকালে ঘুম থেকে উঠে ভালো মতো নাস্তা করতে পারলে পূরণ হবে আপনার সারাদিনের কর্মশক্তির চাহিদা।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ‘সকালে নাস্তা করলে আমাদের মনোযোগ ভালো থাকে এবং ইন্দ্রিয়গুলোও সজাগ থাকে। ফলে নতুন কিছু শেখা যায় ভালোভাবে’।

কাজের সময় আপনার মেজাজ প্রায়ই খারাপ হয়ে যায়?

খেয়াল করে দেখুন এর প্রধান কারণ ক্ষুধা নয় তো? সকালে ভালো নাস্তা করলে মস্তিষ্কের উপর তা ভালো প্রভাব রাখে। মানসিক চাপ কমিয়ে মন-মেজাজ ভালো রাখে। কাজেই দিন যদি ভালোভাবে কাটাতে চান তাহলে সকালে নাস্তা করতে ভুলবেন না যেন।

নোটঃ ডিম, দুধ, মাশরুম, ওটস, বিভিন্ন ধরনের ফল ইত্যাদি স্বাস্থ্যকর খাবার দিয়ে সকালে নাস্তা করুন। এসময় তৈলাক্ত ও ভারী খাবার এড়িয়ে চলুন।

পরিশেষে

আপনার স্বাস্থ্যই আপনার সম্পদ। শরীর ও মন ভালো না রেখে দিন ভালো কাটানোর কথা চিন্তা করা অলৌকিক রূপকথার গল্পের মতই শোনাবে।

আপনি যে ধর্মেরই হয়ে থাকুন, প্রত্যহ সকালে ধর্ম চর্চা করলে সারাদিন মনের মধ্যে যেরূপ আধ্যাত্মিক প্রশান্তি উপলব্ধি করবেন, তার কোন তুলনাই হয় না।

আবার মন ভালো রাখতে গানের ভুমিকাও কম নয়।

তাইতো কবিগুরু বলেছেন,

‘জীবন যখন শুকায়ে যায়
করুণাধারায় এসো।
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়,
গীত সুধারসে এসো।’

Leave a Comment