নিউমোনিয়া শ্বাসতন্ত্রের একটি একিউট ব্যাধি। অর্থাৎ রোগের উপসর্গগুলো দেখা দেয় আকস্মিক। তারপর দ্রুতই সেগুলো প্রকট রূপ ধারণ করে। সাথে এক্সরে বা রেডিওলজিতে সাম্প্রতিককালে তৈরি হওয়া পালমোনারী শ্যাডোয়িং পাওয়া যায়। অর্থাৎ, রেডিওলজির ছবিতে ফুসফুসের কিছু অংশ অন্য অংশের তুলনায় অস্বচ্ছ দেখায়। অনেকটা কুয়াশার মত মনে হয় দেখলে। এই অস্বচ্ছতা ফুসফুসের সেগমেন্ট, লোব বা একাধিক লোবে থাকতে পারে।
কি প্রেক্ষিতে একজন রোগীর নিউমোনিয়া হল সেটি থেকেই বোঝা যায় কোন জীবাণু রোগের জন্য দায়ী। যে কারণে নিউমোনিয়াকে সাধারণতঃ দু’ভাগে ভাগ করা হয়। এক, কমিউনিটি একুয়ার্ড নিউমোনিয়া। অর্থাৎ, সামাজিক মেলামেশা থেকে যে নিউমোনিয়া হয়। যেমন- করোনা ভাইরাস ঘটিত নিউমোনিয়া। অন্যটি হসপিটাল একুয়ার্ড নিউমোনিয়া। রোগ প্রতিরোধে অক্ষম ব্যক্তিদের এই নিউমোনিয়া হয়ে থাকে।
এক্সে-রে ফিল্ম অনুযায়ী নিউমোনিয়ার শ্রেণীবিভাগ
‘লোবার নিউমোনিয়া’একটি রেডিওলজিকাল এবং প্যাথোলজিকাল পরিভাষা। ফুসফুসের এক বা একাধিক লোবের, ‘হোমোজেনাস কনসোলিডেশান’। ফুসফুসের কোন অংশে বাতাস বা তরল জমা থাকলে সেটিকে সাদা নিরেট দেখায় রেডিওলজিতে। এটিই কনসোলিডেশান। হোমোজেনাস অর্থ, সাদা-ভাবটি সকল অংশে সমান।
অধিকাংশ সময় এর সাথে প্লুরা বা ফুসফুসকে আবৃত করে রাখা ঝিল্লীটির প্রদাহও থাকে। অন্যদিকে ব্রঙ্কোনিউমোনিয়াতেও কনসোলিডেশান থাকে। তবে এখানে সাদা-ভাবটি আরও ছড়ানো ছিটানো। এটি এলভিওলার কনসোলিডেশান। অর্থাৎ ফুসফুসের বায়ুথলিগুলি তরল দিয়ে পূর্ণ থাকে। সাথে ক্ষুদ্র শ্বাসনালীকাসমূহ যেমন- ব্রঙ্কাই এবং ব্রঙ্কিওলের প্রদাহও যুক্ত থাকে। অধিকাংশ সময় ফুসফুসের দু’টো লোবই আক্রান্ত হয়।
সামাজিক মেলামেশার মাধ্যমে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া
যুক্তরাষ্ট্রের এক হিসাব দেখা গেছে যে, বছরে প্রতি এক হাজার জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মাঝে পাঁচ থেকে এগার জন সামাজিক মেলামেশার মাধ্যমে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। যাকে কমিউনিটি একুয়ার্ড নিউমোনিয়া বলে। বর্তমান সময়ের করোনা মহামারি কালেও সব ধরণের সামাজিক মেলামেশার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করারও এটাই কারণ ছিল।
লোয়ার রেসপাইরেটোরী ট্র্যাক্ট বা শ্বাসতন্ত্রের নিম্নভাগের রোগের মাঝে ৫ থেকে ১২ শতাংশই এই ধরণের নিউমোনিয়া। কমিউনিটি একুয়ার্ড নিউমোনিয়া পৃথিবী জুড়ে সব ধরণের মানুষকেই আক্রান্ত করে। তবে মূলতঃ বয়সে অতি প্রবীণ ও নবীনরাই বেশী ভুগে থাকেন।
বিশ্বজুড়ে অন্য যেকোন রোগের তুলনায় শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ কমিউনিটি একুয়ার্ড নিউমোনিয়া। সাধারণতঃ ইতিমধ্যেই মুমূর্ষ এবং অতি বৃদ্ধদের মৃত্যুযাত্রাকে ত্বরাণ্বিত করে এই নিউমোনিয়া। যেকারণে রোগটির নামই হয়েছে “ওলড ম্যান্স ফ্রেন্ড” – বৃদ্ধ জনের বন্ধু।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিউমোনিয়ার কারণ ড্রপলেট ইনফেকশান। যা হাঁচি-কাশির মাধ্যমে নিঃসৃত সূক্ষ জলকণার মাধ্যমে সংক্রমণ হয়ে থাকে। সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন। তবে অনেক ধরণের বিষয় রয়েছে যেগুলো শ্বাসতন্ত্রের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কার্যকারিতা হ্রাস করে। এধরণের কারণগুলো থাকলে নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
নিউমোনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ জীবাণু ঘটিত সংক্রমনের নাম- “স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনিয়া”। অন্য জীবাণু আছে কি না সেটি নির্ভর করবে রোগের প্রেক্ষিত এবং রোগীর বয়সের ওপর।
করোনা ভাইরাসের মত ভাইরাসগুলো দিয়ে নিউমোনিয়া হওয়ার ঘটনা সাম্প্রতিককালে বৃদ্ধি পেয়েছে।
যেসব কারণে একজন ব্যাক্তির নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়
যেকোন মানুষই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন। তবে যাদের ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু বিষয় আগে থেকেই বর্তমান থাকে, তাদের নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের সম্ভাবনা বেশী। এই কারণগুলোর ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত।
১। ধূমপান : ধূমপান একটি মারাত্মক বদ-অভ্যাস। তামাকের ধোঁয়া আপনার ফুসফুসের স্বাভাবিক গঠনকে নষ্ট করে দিবে। ফুসফুসের স্থানীয় যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, সেটিকেও বহুলাংশে কমিয়ে দেয় ধূমপানের অভ্যাস।
সুতরাং- আপনি যদি ধুমপানে আসক্ত হয়ে থাকেন তবে, ধূমপান করলে বিভিন্ন মহামারি অবস্থায় (যেমন- COVID-19) আপনার নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের সম্ভাবনা বহুগুনে বেড়ে যাবে; এই তথ্যটি আপনার সর্বক্ষণ মনে রাখা প্রয়োজন।
২। আপার রেসপিরেটোরী ট্র্যাক্টের সংক্রমণ বা শ্বাসযন্ত্রের ওপরিভাগের সংক্রমণ : শ্বাসতন্ত্রের ওপরিভাগ অর্থাৎ নাক, সাইনাস ,গলায় যদি সংক্রমণ থাকে তাহলে সেটি পরবর্তীতে নিউমোনিয়ার রূপ নিতে পারে। সুতরাং নাক, সাইনাস, গলার সংক্রমণ থাকলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসা নিন।
৩। এ্যালকোহল : এ্যালকোহল এমন একটি বাজে জিনিস, যেটি আপনার শরীরের প্রতিটি সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। যারা নিয়মিত মদ্যপান করেন তাদের দেহ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায়। ফলে একজন মদ্যপায়ী সহজেই বিভিন্ন জীবাণু দিয়ে আক্রান্ত হন। অথবা, অপেক্ষাকৃত দুর্বল সংক্রমণেও একজন মদ্যপায়ীর শরীরে প্রবল অসুস্থাবস্থা দেখা দিতে পারে।
৪। গ্লুকোকর্টিকয়েড থেরাপী : প্রেডনিসোলোন, বিক্লোমেথাসোন, বিটামেথাসোন এগুলিই গ্লুকোকর্টিকয়েড জাতীয় ঔষধ। ত্বকের রোগ, বাত, হাঁপানি এবং বিভিন্ন অটো-ইমিউনো ডিজিজে এসব ঔষধ ব্যবহার করে থাকেন মানুষ।
গ্লুকোকর্টিয়েডের মূল কাজ আপনার শরীরের অনিয়ন্ত্রিত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার হাত থেকে আপনাকে রক্ষা করা। অর্থাৎ এই ঔষধগুলো কিন্তু আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেই দমন করছে। সুতরাং, ঐ সুযোগে নিউমোনিয়ার জীবাণু আপনাকে আক্রমণ করতে পারে।
৫। বৃদ্ধ বয়স : বার্ধক্য শরীরের স্বাভাবিক সক্ষমতা অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। ফলে নিউমোনিয়া হওয়ার উপযুক্ত ক্ষেত্রও তৈরি হয়।
৬। সাম্প্রতিক সময়ে ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণ : সাম্প্রতিক সময়ে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে থাকলে আপনার ফুসফুসের স্থানীয় রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থা দুর্বল অবস্থায় থাকবে। ফলে সহজেই নিউমোনিয়ার জীবাণু দিয়ে আক্রান্ত হতে পারেন।
৭। আগে থেকে বিদ্যমান ফুসফুসের রোগ : প্রথম থেকেই ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ , যেমন সি-ও-পি-ডি, যক্ষা ইত্যাদিতে আক্রান্ত থাকলে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের সম্ভাবনা বহুগুণে বেড়ে যায় ।
৮। এইচ-আই-ভি : এই-আই-ভি দেহের রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে সবধরণের রোগের আক্রান্ত হওয়ারই সম্ভাবনা বেড়ে যায়। নিউমোনিয়াও তার মাঝে অন্যতম।
৯। গৃহাভ্যন্তরে বায়ু দূষণ : যেসব বাড়িতে মাটির চুলা থাকে, সেখানে লাকড়ি বা কাগজপত্র পোড়ানের ফলে বিষাক্ত ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। বাড়ির ভেন্টিলেশান ভালো না হলে এই ধোঁয়া ঘরের মাঝে আটকা পড়ে যায় এবং শ্বাসতন্ত্রে বিভিন্ন ধরণের রোগ বালাইয়ের সৃষ্টি করে।
তাছাড়া বদ্ধ ঘরে সিগারেট খেলেও, আপনার বাড়ির ভেতরকার বায়ু দূষিত হবে। এই দূষিত আবহাওয়া নিউমোনিয়া হওয়ার জন্য আদর্শ।
নিউমোনিয়া রোগের বৈশিষ্ট্য ও উপসর্গগুলোঃ কখন বুঝবেন নিউমোনিয়া হয়েছে?
নিউমোনিয়ার উপসর্গগুলো প্রথমেই শনাক্ত করতে পারা জরুরী। প্রাথমিক অবস্থাতেই চিকিৎসা শুরু করা গেলে রোগ গুরুতর রূপ ধারণ করে না এবং নিউমোনিয়া জনিত মৃত্যু থেকে রোগী রক্ষা পেতে পারেন।
নিউমোনিয়া, বিশেষ করে লোবার নিউমোনিয়া, একটি ‘একিউট ইলনেস’ (রোগের উপসর্গগুলো প্রকাশ পায় আকস্মিক, এবং দ্রুত তীব্র রূপ নেয়)।
বিভিন্ন সিস্টেমিক ফিচার যেমন, জ্বর, শীত ভাব, শরীরে কাঁপুনি, অসুস্থ ভাব এসবই প্রধান রূপে দেখা দেয়। রোগীর ডেলিরিয়াম থাকতে পারে। অর্থাৎ, মানসিক ভাবে সে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। সাধারণতঃ মুখে রুচি থাকে না। মাথা ব্যাথার কথা বলে থাকেন রোগী।
শ্বাসতন্ত্রের উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে কাশি। প্রথমদিকে কাশির স্থায়িত্ব হয় কম। কাশির সময় রোগীর যন্ত্রণা হয়। এটি নিউমোনিয়ার একটি বৈশিষ্ট্য। তবে পরবর্তীতে কাশির সাথে‘মিউকোপিউরুলেন্ট স্পুটাম’ বা মিউকাস ও পুঁজ সমৃদ্ধ শ্লেষ্মা উঠে আসে।
স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনিয়া’ জীবাণুটি দিয়ে নিউমোনিয়া বাঁধালে, শ্লেষ্মার বর্ণ হয় রাস্ট-কালার্ড বা মরিচাবর্ণ। মাঝে মাঝে কিছু রোগী হিমোপ্টাইসিস বা কাশির সাথে রক্তের অভিযোগ করতে পারেন।
নিউমোনিয়ার রোগীদের ‘প্লুরাইটিক চেস্ট পেইন’ থাকতে পারে। অর্থাৎ শ্বাস প্রশ্বাস, কাশির সময় তীব্র আকস্মিক ছুরি বিঁধে যাওয়ার ব্যাথা হয় বুকে। অনেক ক্ষেত্রে এই যন্ত্রণার উৎস বুকে হলেও রোগী ব্যথা অনুভব করবেন কাঁধে বা পেটের সামনের অংশে।
লোয়ার-লোব-নিউমোনিয়া , এবং অনেক ক্ষেত্রে হেপাটাইটিসের রোগীদের ক্ষেত্রে ‘ আপার এবডমিনাল টেন্ডারনেস’ থাকতে পারে অনেক সময়। অর্থাৎ, পেটের ওপরের অংশে হাত দিলেই যন্ত্রণার অনুভূতি হবে রোগীর।
যে বিভিন্ন জীবাণুগুলো (করোনা ভাইরাস ব্যাতীত) দিয়ে নিউমোনিয়া হতে পারে
বিভিন্ন জীবাণু দিয়ে নিউমোনিয়া হয়। প্রতিটিতেই রোগের ক্লিনিকাল এবং রেডিওলজিকাল চিত্রটি প্রায় একইরকম। তারপরও পূর্বসূত্র সাপেক্ষে সম্ভাব্য জীবাণুটিকে শনাক্ত করা যায়।
‘মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া’ দিয়ে সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হন কমবয়সীরা। বেশী বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি দেখা যায় না।
বয়স্করা সাধারণতঃ ‘হিমোফিলিয়াস ইনফ্লুয়েঞ্জা’ দিয়ে আক্রান্ত হন। বিশেষ করে যাদের আগে থেকেই ফুসফুসের কোন রোগ ছিল।
‘লিজিওনেলা নিউমোফিলিয়া’ সাধারণতঃ স্থানীয় প্রাদুর্ভাব রূপে দেখা দেয়। জীবাণু অধ্যুষিত হোটেল, হাসপাতাল, শিল্প কারখানায় সংক্রমণের প্রাথমিক উৎস।
সাধারণতঃ ইনফ্লুয়েঞ্জার পরপরই ‘স্ট্যাফিলোকক্কাসে’ আক্রান্ত হয় মানুষ।
‘ক্লিবসীয়েলা নিউমোনিয়ার’ সাথে মদ্যপানে একটি বিশেষ যোগাযোগ আছে। অধিকাংশ সময় একটি গুরুতর ব্যাক্টেরিমিক-ইলনেস অর্থাৎ রক্তে অধিক মাত্রায় ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতি সহকারে এটি প্রকাশিত হয়।
সাম্প্রতিক বিদেশ ভ্রমণ অনেক ধরণের সংক্রমণের সম্ভাবনাকে হাজির করে। যেমন করোনা ভাইরাস ( বর্তমান পরিস্থিতিতে এটির সাথে অবশ্য বিদেশ ভ্রমণের তেমন প্রাসঙ্গিকতা নেই আর)। অথবা বার্খোল্ডেরিয়া সিউডোমোনালি দিয়ে হয় মেলিওয়ডোসিস। তাছাড়া নর্থ বা সাউথ আমেরিকা ভ্রমণ করে আসার পর বিভিন্ন ফাংগাল সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে।
নিউমোনিয়ার রোগীর যে লক্ষণগুলো চিকিৎসকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ
নিউমোনিয়ার রোগীকে পরীক্ষা করার সময় চিকিৎসক প্রথম যে জিনিসগুলো দেখবেনঃ
শ্বাসপ্রশ্বাসের হার, নাড়ীর স্পন্দন বা পালস রেট, রক্তচাপ এবং রোগীর মানসিক ভারসাম্য ঠিক রয়েছে কি না। রোগ কতটুকু গুরুতর সেটি নির্ণয়ের জন্য এগুলো খুবই জরুরী।
“চেস্ট সাইন” বা রোগীর বুক পরীক্ষা করে বিভিন্ন ধরণের লক্ষণ পেতে পারেন ডাক্তার। প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়ার ওপর সেটি নির্ভর করবে।
এই প্রতিক্রিয়ার তিনটি পর্যায়ঃ স্টেজ অফ একিউট এক্সুডেশান, রেড হেপাটাইযেশান তারপর গ্রে-হেপাটাইযেশান।
ফুসফুস কনসোলিডেটেড বা তরলে পূর্ণ থাকলে, পারকাশান করে তেমন কিছু শোনা যায় না। তবে ঘন মাধ্যমে শব্দের গতিবেগ বৃদ্ধি পাওয়ায়, স্টেথোস্কোপ বসালে ব্রঙ্কিয়াল ব্রিদিং শোনা যায়।
অর্থাৎ ফুসফুসের সূক্ষ্নতম বায়ুপথগুলোতে বায়ু চলাচলের শব্দ চিকিৎসক শুনতে পাবেন। যেটি এমনি সময়ে শোনা যায় না।
তাছাড়াও আরও থাকতে পারে “হুইস্পারিং পেকটোরিলোকুয়ে”। অর্থাৎ, স্টেথোস্কোপ কানে থাকাবস্থায়, রোগী যদি ফিসফিস করে কিছু বলেন সেটিও স্পষ্ট শুনতে পাবেন ডাক্তার। যেটি এমনি সময়ে সম্ভব নয়। আর সাথে থাকবে ‘ক্র্যাকেল’ বা ফুসফুসে জমা হওয়া তরলের মধ্যে বায়ুপ্রবাহজনিত মৃদু খর্খর শব্দ।
নিউমোনিয়াকে অন্য যেসব রোগ ভেবে ভুল হতে পারে
- পালমোনারী ইনফার্কশান
- পালমোনারী বা প্লুরাল টিউবারকুলোসিস
- পালমোনারী ইড়িমা
- পালমোনারী ইয়োসিনোফিলিয়া
- ব্রঙ্কোএলভিওলার সেল কার্সিনোমা
- ক্রিপটোজোনিক অর্গানাইজিং নিউমোনিয়া বা ব্রঙ্কিওলাইটিস অবলিটেরান্স অর্গানাইজিং নিউমোনিয়া
পরীক্ষা নীরিক্ষার মাধ্যমে যেভাবে নিউমোনিয়া শনাক্ত করা যায়
পরীক্ষা নীরিক্ষার মূল উদ্দেশ্য রোগের নির্ণয়ে নিশ্চিত হওয়া। রোগ কতটুকু গুরুতর তার মূল্যায়ন করতে হবে। শনাক্ত করতে হবে কি কি জটিলতার উদ্ভব হল।
নিউমোনিয়া অতটা জটিলাকার ধারণ না করলে জীবাণু শনাক্ত ব্যাতীতই চিকিৎসা করা যায়। তবে রোগ গুরুতর রূপ নিলে মাইক্রোবায়োলজিকাল পরীক্ষাগুলো করতেই হবে।
১। রক্তপরীক্ষা (ব্লাড-কাউন্ট) :
শ্বেত রক্ত কণিকার পরিমাণ খুব বেশী (প্রতি লিটারে ২০ গুণ টেন টু দি পাওয়ার নাইনের বেশী) বা খুব কম থাকলে (লিটারে চার গুণ টেন টু দি পাওয়া নাইনের কম) বুঝতে হবে রোগ গুরুতর। নিউট্রোফিল লিউকোসাইটোসিস যদি প্রতি লিটারে ১৫ গুণ টেন টু দি পাওয়ার নাইনের বেশী হয়, তাহলে বুঝতে হবে নিউমোনিয়াটি ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত।
হিমোলাইটিক এনিমিয়া : মাইকোপ্লাজমার জটিলতা থেকে এমন হতে পারে ।
২। ইউরিয়া এবং ইলেকট্রোলাইট :
ইউরিয়া প্রতি লিটার ৭ মিলিমোলের বেশী হলে বুঝতে হবে রোগ জটিল রূপ নিচ্ছে।
হাইপোন্যাট্রেমিয়া বা রক্তে সোডিয়ামের পরিমাণ কম থাকা মানে রোগ খারাপ দিকে যাচ্ছে।
৩। লিভার ফাংশান টেস্ট :
‘বেযাল নিউমোনিয়া’বা ফুসফুসের নিম্নভাগের নিউমোনিয়া যদি তার ঠিক নীচেই অবস্থিত লিভারেও প্রদাহ ঘটায় তাহলে লিভার ফাংশানের রিপোর্টগুলো খারাপ আসবে।
হাইপোএলবুমিনেমিয়া : অর্থাৎ রক্তে এলবুমিনের মাত্রা কমে যাওয়া। এটি রোগ খারাপের লক্ষণ।
৪। এরিথ্রোসাইট সেডিমেন্টেশান রেট এবং সি-রিয়েকটিভ প্রোটিন।
৫। ব্লাড-কালচার : ব্যাক্টেরেমিয়া বা রক্তে ব্যাক্টেরিয়া বৃদ্ধি পাওয়া, রোগ গুরুতর হওয়ার লক্ষণ।
৬। কোল্ড-এগ্লুটিনিন পরীক্ষা: মাইকোপ্লাজমার রোগীদের পঞ্চাশ ভাগ ক্ষেত্রে এটি পজিটিভ
৭। আর্টেরিয়াল ব্লাড গ্যাস : অক্সিজেন স্যাচুরেশান তিরানব্বই শতাংশের কম হলে ,এবং রোগের বৈশিষ্ট্যগুলো তীব্র রূপ নিলে এটি পরিমাপ করা হয়। শ্বাসযন্ত্রের বিকল হয়ে পড়া বা এসিডোসিসের মাত্রা নির্ণয়ের জন্য এই পরীক্ষা প্রয়োজনীয়।
৮। কফ পরীক্ষা : কফের নমুনা সংগ্রহ করে গ্রাম স্টেইন, কালচার এবং এন্টিমাইক্রোবিয়াল সেন্সিটিভিটি পরীক্ষা করা হয়।
৯। ওরোফ্যারিঙ্কস সোয়াব ( থ্রোট সোয়াব):করোনা ভাইরাস,মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া বা অন্যান্য অপ্রচলিত জীবাণুগলো নির্ণয়ের জন্য পলিমারেজ চেইন রিআকশান পরীক্ষার জন্য এই নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
১০। ইউরিন বা মূত্র পরীক্ষা : নিউমোকক্কাল এবং লিজিওনেলা এন্টিজেন নির্ণয়ের জন্য এই পরীক্ষা করা হয়
১১। বুকের এক্স-রে : নিউমোনিয়া রোগীর বুকের এক্সরে-তে যা পাওয়া যেতে পারে –
– লোবার নিউমোনিয়া: এক্ষেত্রে এক্সরেতে আক্রান্ত লোবটির ইতস্তত অস্বচ্ছতাগুলো (প্যাচি ও পাসিফিকেশান) একসময় হোমোজেনাস কনসোলিডেশানে রূপ নেয়। অর্থাৎ পুরো লোবটাই (বাম ফুসফুসের দু’টি এবং ডান ফুসফুসের তিনটি লোব থাকে) তরলে পূর্ণ হয়ে নিরেট সাদা দেখায় এক্সের ফিল্মে।
– এয়ার ব্রঙ্কোগ্রাম : (বাতাসে পূর্ণ ব্রঙ্কাই, কনসোলিডেটেড ফুসফুস টিস্যুর সাপেক্ষে দীপ্তিমান দেখায়)।
– ব্রাঙ্কোনিউমোনিয়া : অস্বচ্ছতা সাধারণতঃ ছত্রছাড়া বা প্যাচি। সেগমেন্টগুলোতে অস্বচ্ছতা থাকে।
নিউমোনিয়া ঘটিত যেসব জটিলতা এক্সরে’তে ধরা পড়ে
প্যারা নিউমোনিক এফিউশান, ইন্ট্রাপালমোনারী এবসেস, এমপায়েমা।
স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস : মাল্টিলোবার শ্যাডোয়িং , ক্যাভিটেশান (ফুসফুসে গ্যাসে পূর্ণ অঞ্চলের উপস্থিতি), নিউমাটোসিলস এবং এবসেস।
প্লুরাল ফ্লুইড বা বুকে পানি জমা : যদি ফ্লুইডের পরিমাণ সাধারণের চেয়ে বেশী হয় তরলটি টেনে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখবেন চিকিৎসক।
করোনা ভাইরাসের এই সময়ে নিউমোনিয়াই আমাদের প্রধান আতংক। বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করা এখন খুবই জরুরী। নিউমোনিয়ার আদর্শক্ষেত্র তৈরী করে এমন অভ্যাসগুলো ত্যাগ করুন এবং উপসর্গগুলো দেখা দেয়া মাত্রই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
রেফারেন্স : ডেভিডসন্স মেডিসিন, রবিন্স প্যাথলজি, ডব্লিউ এইচ ও গাইডলাইন এবং চিকিৎসাপেশায় লেখকের ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা।
লেখক : ডা. সালেহ মুহাম্মাদ, এমবিবিএস (ডি-ইউ)।
প্রয়োজন মনে হলে পড়ে দেখতে পারেন-