বর্তমান আধুনিকায়নের যুগে মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটারে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটে। এগুলো থেকে বিচ্ছুরিত রঞ্জক রশ্মি আমাদের চোখের অনেক বেশি ক্ষতি করে থাকে। যেমনঃ চোখ জ্বালাপোড়া, চোখ ব্যথা করা, চোখে ঝাপসা দেখা, চোখ দিয়ে পানি পরা, চোখে কম দেখা ইত্যাদি। আজকের এই লেখাতে দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সক্ষম এমন ১০টি খাবার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
আলোকিত সুন্দর পৃথিবী চোখের মাধ্যমে আমরা অবলোকন করি। চোখ আমাদের অবিচ্ছেদ্য শারীরিক অংশ। তাই চোখের যত্নের বিষয়টা সবার আগে আসে। ইন্টারনেটের বিভিন্ন ভিডিও, গেমস, সোশ্যাল মিডিয়ার উপাদান ইত্যাদি বানানোর উদ্দেশ্যই হলো কতোক্ষণ ব্যবহারকারীকে আকৃষ্ট করে আটকে রাখা যায় স্ক্রীণের পর্দার সামনে। এবং, আমরাও কোনো এক পর্যায়ে এগুলোতে বাজেভাবে আকৃষ্ট হয়ে যাই।
একটানা তাকিয়ে থাকার কারনে ক্ষতিকর প্রভাব পরে চোখে এবং দৃষ্টিশক্তির বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। তাই মোবাইল অথবা কম্পিউটারের স্ক্রিনে একটানা কখনোই তাকিয়ে থাকবেন না। যতো বেশি পারেন চোখের পলক ফেলবেন অর্থাৎ চোখ পিট পিট করবেন। এবং, প্রতি ১০/১৫ মিনিট পর পর অন্যদিকে ৫ সেকেন্ডের জন্য তাকাবেন। এগুলোর চর্চা করার পাশাপাশি চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়ানোর জন্য যে খাবারগুলো খেতে পারেন তাঁর একটি ছোট্ট তালিকা বিবরণসহ নিচে উল্লেখ করা হলো।
১। গাজর
রঙিন সব্জি গাজর খেতে যেমন সুস্বাদু ঠিক তেমনি পুষ্টিগুনেও সেরা। এই সব্জিটি রান্না ও কাঁচা উভয়ভাবেই খাওয়া যায়। এতে আছে পর্যাপ্ত পরিমানে ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, ভিটামিন কে, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ফাইবার, পটাসিয়াম, বিটা-ক্যারোটিন ইত্যাদি। এই উপাদানগুলো দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে বিশেষ ভুমিকা পালন করে। এতে থাকা বিটা ক্যারোটিন লিভারে গিয়ে ভিটামিন এ হয় এবং পরবর্তীতে রেটিনায় গিয়ে চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়।
গাজর বেগুনি পিগমেন্টের সংখ্যা বাড়ায়; যা রাতে স্পষ্ট দেখতে দৃষ্টিশক্তি দ্বিগুন করে। এতে থাকা ভিটামিন চোখের ভেতর গিয়ে আলোকশক্তি শোষণ করে। ফলে দৃষ্টিশক্তি প্রখর হয়। তাই দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে গাজরের ভুমিকা অনস্বীকার্য। চোখ ভালো রাখতে অবশ্যই দৈনিক খাবার তালিকায় পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ গাজর রাখুন।
২। পালংশাক
বয়স বাড়ার সাথে সাথে চোখের ম্যাকুলা নামক অংশ ক্ষয় হতে থাকে। পালংশাকে থাকা লুটেইন ও জিয়াজ্যানথিন এই ক্ষয় রোধে ভুমিকা রাখে। সবুজ শাকসবজিতে রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ, যা সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রেটিনাকে রক্ষা করে। তাই দৈনিক খাবার তালিকায় অন্যান্য শাকসবজির পাশাপাশি পালংশাক রাখুন।
৩। ভুট্টা
ভুট্টায় রয়েছে আয়রন, লাইকোপিন, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, বি ১২ ইত্যাদি। এই উপাদানগুলো দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে ও চোখকে ছানি পরার হাত থেকে রক্ষা করে।
৪। লেবু
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল বেশি বেশি খেতে হবে। যেমনঃ লেবু, কমলা, মালটা, ইত্যাদি ফলগুলো। এগুলোতে রয়েছে সাইট্রিক এসিড ও প্রচুর ভিটামিন সি। সাইট্রিক এসিডে রয়েছে শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। এগুলো পেশির ক্ষয়রোধ করে থাকে। আমাদের দৃষ্টি শক্তি প্রখর করে তোলে।
৫। মাছ
চোখের সমস্যার কথা ওঠলেই একেকজন জেনে, না জেনে ছোট মাছ খাওয়ার পরামর্শ দেন। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত থাকা খুবই জরুরী। ছোট মাছে থাকে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন এ। ভিটামিন এ, রাতকানা, চোখে ঝাপসা দেখা, চোখের আরো অনেক সমস্যার প্রতিকার করে। এছাড়াও ফ্যাটি এসিড আমাদের চোখকে ভালো রাখে। মাছে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমানে ফ্যাটি এসিড। সামুদ্রিক মাছে আছে, ভিটামিন বি ১২, পটাশিয়াম, সেলেনিয়াম, ওমেগা থ্রি ইত্যাদি খনিজ ও ভিটামিন। তাই চোখ ভালো রাখতে খাবার তালিকায় মাছ অবশ্যই রাখতে হবে।
৬। দুধ
দুধে আছে প্রোটিন ও জিংক। জিংক চোখের ছানি পরা প্রতিরোধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এছাড়াও দুধে আছে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন এ। তাই দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার বেশি বেশি খেতে হবে।
৭। মিষ্টি আলু
মিষ্টি আলুতে আছে ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ভিটামিন ডি ও বিটা ক্যারোটিন। এই পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ উপাদানগুলো চোখকে ভালো রাখে।
৮। বাদাম
বুদ্ধি বাড়াতে বাদাম যেমন উপকারী ভুমিকা রাখে ঠিক তেমনি চোখ ভালো রাখতেও বাদামের ভুমিকা অনস্বীকার্য। বাদামে থাকা পুষ্টিগুন মূলত প্রার্থমিক পর্যায়ে বেশি উপকার করে। অর্থাৎ যারা চোখের সমস্যায় ভুগছেন না তারা নিয়মিত বাদাম খেলে বিভিন্ন রকমের চোখের সমস্যা থেকে বেঁচে থাকতে পারবেন। এছাড়াও যাদের প্রথম প্রথম সমস্যা দেখা দিয়েছে, তারাও ভালো উপকার পাবেন। তাই চশমা পরতে না চাইলে আজ থেকেই নিয়মিত বাদাম খাওয়া শুরু করে দিন।
৯। কচু শাক
কচু শাকে আছে ক্যালসিয়াম, লৌহ, ভিটামিন -এ, ভিটামিন সি ইত্যাদি। সবুজ শাকসবজিতে বরাবরই ভিটামিন ও খনিজ উপাদান থাকে। সে দিক থেকে বিবেচনা করতে গেলে কচু শাকের নাম সবার আগে চলে আসে। রক্ত পরিষ্কার করতে ও চোখের বিচ্যুতি ঠিক করতে নিয়মিত কচু শাক খান।
১০। ব্রকলি
ব্রকলিতে বহুমাত্রিক স্বাস্থ্যগুন বিদ্যমান। যে ভিটামিনগুলো চোখের জন্য উপকারী সেগুলো ভরপুর রয়েছে। যেমনঃ লুতিন, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই। সূর্যের বেগুনি রশ্মির কারনে চোখের যে সমস্যা হয়ে থাকে তাকে বলে ফটো ড্যামেজ। এই ফটো ড্যামেজ প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে ব্রকলির ভূমিকা অসাধারণ। ব্রকলি তরকারি অথবা সম্পূর্ণ সিদ্ধ করে খাওয়ার চেয়ে আধা সিদ্ধ করে খেলে এর পুষ্টিগুন বজায় থাকে ও বেশি উপকার পাওয়া যায়।
চোখের সমস্যা সমাধানে একটি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার কথা না বললেই নয়– আমলকি, হরিতকি, বহেরা এই তিনটি উপাদান চূর্ণ করে যে গুড়ো বানানো হয় তাকে ত্রিফলা বলে। ত্রিফলা চোখের বর্ণ পৃথক করার ক্ষমতা রাখে। চোখের ভিতরের কোষ ও সুক্ষ্ম শিরাগুলোর সুরক্ষা করে। ত্রিফলা খেতে হয় পানির সাথে মিশিয়ে খালি পেটে। আয়ুর্বেদে ত্রিফলার অনেক সুনাম আছে। চোখের বিচ্যুতি গুলো ঠিক করতে ত্রিফলা খেতে পারেন নির্দিধায়।
উক্ত খাবার গুলো খাওয়ার পাশাপাশি কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে-
বিরতি নেওয়া
একটানা রঙিন স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলে চোখের পেশিগুলো ক্লান্ত হয়ে যায়। তারপর মাথা ব্যথা আরো নানা উপসর্গ দেখা দেয়। তাই ছোট, বড় প্রত্যেকের ব্রাইটনেস কমিয়ে ইলেকট্রিক ডিভাইসগুলো চালাতে হবে। আধঘন্টা পরপর ৫ মিনিটের জন্য বিরতি নিতে হবে। এই ৫ মিনিট অন্য যেকোনো অবজেক্টের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। প্রথমে দূরবর্তী কোনো বস্তুতে ফোকাস রাখতে হবে ২/১ মিনিট। তারপর সামনের বস্তুর উপর ফোকাস রাখতে হবে। তৃতীয়ত ২০-৪০ বার চোখের পলক ফেলতে হবে। কম আলোতে কাজ করলে চোখের উপর অনেক চাপ পরে। তাই রাত হোক বা দিন সবসময় পর্যাপ্ত আলোতে কাজ করুন। চোখকে আদ্র ও শিথিল রাখতে সকালে হাঁটতে বের হোন। এই অভ্যাস স্বাস্থ্যের পক্ষে যতোটা উপকারী ততোটা চোখের পক্ষেও। তাই সার্বিক দিক বিবেচনা করে সকালে সতেজ পরিবেশে হাঁটুন। পাশাপাশি চোখ পরিষ্কার ও চোখের ব্যয়াম করতে ভুলবেন না যেনো!
চোখ পরিষ্কার করা
গোলাপজল বড় কাপ পানিতে ৪-৫ ফোটা নিয়ে পানি মেশাতে হবে এবং সে পানিতে চোখ মেলে ডুবিয়ে রাখতে হবে। এতে করে চোখের ময়লা আবর্জনা দূর হবে। গোলাপজল আর পানি মিশিয়ে দ্রবণটি দিয়ে দিনে একবার পরিষ্কার করলেই হবে। এছাড়াও সকাল বা বিকেলে পানির ঝাপ্টা চোখে দিতে হবে।
ব্যায়াম
আমাদের শরীরের যেমন ব্যায়াম করলে রোগ ব্যাধি ভালো হয়ে যায় এবং নানা রকমের রোগ থেকে বেঁচে থাকা যায়, ঠিক তেমনি চোখেরও ব্যায়াম আছে। চোখের নিয়মিত ব্যায়াম করার ফলে চোখে ত্রুটিসমুহ ভালো হয়ে যায় ও দৃষ্টিশক্তি প্রখর হয়। আধঘন্টা পর পর দুই হাত ঘসে গরম করে হাত দুইটি আলতো করে চোখে চাপ দিয়ে রাখুন। এরকম ৩-৪ বার করুন। গুনে গুনে ২০-৩০ বার চোখ বন্ধ করুন, খুলুন। ডানে, বামে, উপরে, নিচে পর্যাক্রমে ১০-২০ বার তাকান। এই সহজ ব্যয়ামগুলো ছাড়াও ইউটিউবে আরো অনেক ধরনের চোখের ব্যয়াম রয়েছে। সেগুলো নিয়মিত করলে চোখ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
Featured Photo by Perchek Industrie on Unsplash
প্রয়োজন মনে হলে পড়ে দেখতে পারেন-