ডিপ্রেশন দূর করার ৭টি কার্যকরী উপায়

ডিপ্রেশন দূর করার উপায় জানার আগে, ডিপ্রেশন কি? কেনো হয় এগুলো নিয়ে সঠিক ধারনা থাকা উচিত। ডিপ্রেশন মুলত এক ধরনের মানসিক ব্যাধি। বর্তমানের বহুল প্রচলিত শব্দ এটি। সাধারণত একাকিত্ব, আকাঙ্ক্ষার কিছু না পাওয়া, অপমান, ব্যক্তিগত জীবনের দুশ্চিন্তা, আচমকা বৃহৎ পরিবর্তন, অতিরিক্ত খাওয়া, ওজন হ্রাস অথবা বৃদ্ধি, বিরক্তি, অস্থিরতা, অনিদ্রা ইত্যাদির কারনে হীনমন্যতায় ভুগতে ভুগতে আশেপাশের সব কিছু যখন অতিষ্ট লাগে; সেই অবস্থাটাকেই আমরা ডিপ্রেশন বলে থাকি।

তারপর এমন পরিস্থিতি আসে যখন বেঁচে থাকাটা বিষাদকর মনে হয়। অবচেতন মন তখন মুক্তির খোঁজ করে। এবং, কোনো পথ না মেললে সুইসাইডকে বেছে নেয়! আমাদের আশেপাশে অনেক মানুষ ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে সুইসাইড করছে। এ ভয়াবহ পরিস্থিতি ঠেকাতে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। চলুন জেনে নেয়া যাক কিভাবে –

১. মেডিটেশন করুন

আমাদের মন অনেক বেশি অশান্ত প্রকৃতির। নানা রকমের চিন্তা খেলা করে এখানে। আর চিন্তা থেকেই শুরু হয় দুশ্চিন্তা। এতো বেশি চিন্তার ফলে ছোটখাটো বিষয়েও ভেঙে পরা কাজ করে। নিজেকে জানতে, নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে এই অশান্ত মনকে শান্ত করা খুব প্রয়োজন।

মানসিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে মেডিটেশন সবচেয়ে কার্যকরী ভুমিকা পালন করে। অনেকেরই ধারনা মেডিটেশন কিছু কিছু ধর্মাবলম্বীদের নিদর্শন! এটি কিন্তু মোটেও সত্যি না।

মেডিটেশন হলো মনকে শান্ত করার একটি প্রক্রিয়া। মেডিটেশনের ফলে আমাদের মন আশেপাশের অহেতুক চিন্তা ভাবনা থেকে সরে আসে এনং এক জায়গায় কেন্দ্রীভুক্ত হয়। মস্তিষ্কের আলফা ওয়েভ নিঃস্বরন বৃদ্ধি করে মেডিটেশন; যা আমাদের রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ, অহেতুক চিন্তা অনেকাংশ কমিয়ে ফেলে।

যেভাবে মেডিটেশন করবেন

১. শান্ত কোনো পরিবেশ ঠিক করুন। যেখানো আলো বাতাস ভালোভাবে চলাচল করে।
২. হাতমুখ ধুয়ে সতেজ হতে হবে।
৩. পরিষ্কার পরিছিন্ন, পাতলা পোশাক পরিধান করতে হবে।
৪. আপনি যেভাবে বসতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন, সেভাবেই বসতে হবে।

উপরোক্ত বিষয়গুলো মেনে সুন্দর করে বসে পরুন। চাইলে চোখ খোলা রাখতে পারেন। চোখ খোলা বা বন্ধ রাখা তেমন ম্যাটার করে না। তারপর জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিন ও ছাড়ুন।

বাকি সব কিছু ঝেরে ফেলে নিশ্বাসে মননিবেশ করুন। নিশ্বাস কিভাবে প্রসারণ হচ্ছে, কিভাবে সংকোচন হচ্ছে, সে দিকে মনোযোগ দিন। মনে অন্য কোনো চিন্তা আসলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই, সেখান থেকে সরে এসে শ্বাস ওঠা নামায় মনোযোগ দিন। এভাবে সকালে ১০-১৫ মিনিট করলে সারাদিনটা অনেক সতেজ কাটবে। এই মেডিটেশনটিকে মাইন্ডফুলনেস মেডেটেশন বলে। যা আমাদের যাবতীয় চিন্তাভাবনা দূর করতে সাহায্য করে এবং একটি নির্দিষ্ট জায়গায় কেন্দ্রীভুক্ত করে।

২. ব্যস্ত থাকুন

ব্যস্ততা আমাদের কিছু নির্দিষ্ট জিনিসে ব্যস্ত রাখে। অন্য সব চিন্তা করার সুযোগ দেয় না। যে যতো একাকিত্বের মধ্যে থাকেন বা কাজ খুব কম করেন, তারা আজে বাজে চিন্তা করার সময়ও বেশি পান। এক্ষেত্রে এগুলো থেকে বেঁচে থাকতে অবশ্যই নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।

হতে পারে সেটা অফিসের কাজ, হতে পারে জিম করা, মুভি দেখা, গান শোনা, আর্ট করা, বই পড়া, নাটক দেখা, খেলা করা, হাঁটতে বের হওয়া, বাগান করা, পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটানো, প্রভৃতি।

আরো অনেক ধরনের হবি থাকতে পারে। না থাকলেও কিছু একটা অবশ্যই করা প্রয়োজন। ব্রেনকে বাজে চিন্তা করার সুযোগ একদম দেওয়া যাবে না। যেটাই করুন না কেনো নিজের শতভাগ দিয়ে করুন। ওই কাজটা না হলেও মনে প্রশান্তি আসবে। সাথে কে কি বললো, কে জীবনে থাকলো বা চলে গেলো, কে আগের মতো আর পাত্তা দেয় না; এসব চিন্তা করার সময়ও থাকবে না।

৩. রাগ ক্ষোভ থেকে বেরিয়ে আসুন

কোনো আকাঙ্ক্ষার কিছু না পেলে বা কোনো কিছু মনমতো না হলে আমাদের অনেক বেশি রাগ লাগে। ক্ষোভে শরীর কাঁপে। রাগটা হতে পারে নিজের উপর। হতে পারে অন্য কারো উপর। এর জন্য বাকি সময়টা জঘন্য বাজে কাটে!

এক্ষেত্রে আমাদের চিন্তা করা উচিত- যে বিষয়টার জন্য রাগ লাগছে, সে বিষয়টা চিন্তা করে যে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে; তার ফলে বাকি যে সময়টুকু আমাদের ছিলো, যে সময়টা আমরা সুন্দরভাবে কাটাতে পারতাম, সেই সময়টুকু এই ক্ষোভ থেকে তেরি হওয়া ডিপ্রেশন কেড়ে নিচ্ছে।

যার উপর রাগ করছি তার কিন্তু কিচ্ছু যায় আসে না। সে রাগের পরোয়া করে না। পরোয়া করলে রাগ করতে হতো না! এটা গেলো একটা পয়েন্ট, আরেকটা পয়েন্ট হচ্ছে- রাগ করলে কেউ আকাঙখিত বস্তুটি পেয়ে যায় না। বরং রাগের ফলে বাকি সময়টা অনেক বাজে যায়।

একটা প্রবাদ আছে- রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। অর্থাৎ রাগের সময় যদি আমরা অধৈর্য হয়ে যাই এবং পরবর্তী সময় রাগটাকে ধরে রেখে ক্ষোভ তৈরি করি তাতে কিন্তু কারো কিচ্ছু যায় আসে না।

প্রতিনিয়ত সে ক্ষোভটা মনে রাখা, রাগ করে বসে থাকা মূলত হেরে যাওয়ার লক্ষণ। রাগ করলে কারো কিছুই হয় না। কিছুই যায় আসে না। কারো বাড়ি ঘর সেই রাগের আগুনে পুড়ে যায় না। এটা আমিও জানি, আপনিও জানেন।

উপরোক্ত বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝলে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, রাগ বা ক্ষোভ কোনো সময়ই আমাদের কল্যাণ বয়ে আনে না। বরং ক্ষতি করে। তাই রাগ বা ক্ষোভ ঝেরে ফেলে দিন। ফলে চিন্তাটাও দূর হয়ে যাবে এবং একই জিনিস নিয়ে বারবার ভাববেন না।

৪. পর্যাপ্ত ঘুমান

শরীর সুস্থ্য, সতেজ ও ভালো রাখতে পর্যাপ্ত ঘুমের বিকল্প নেই। ৬-৮ ঘন্টা শরীরের জন্য সুষ্ঠু ঘুমের সীমা। ঘুম না হলে বিরক্তিবোধ কাজ করে। মুড অফ হয়ে থাকে। মাথা ব্যথা, মাথা কাজ না করা প্রভৃতি সমস্যা হয়। দেহের নির্জীবতা কাটাতে পর্যাপ্ত ঘুমান। এর জন্য রাতে হট শাওয়ার অনেক বেশি কার্যকর। ঘুমোতে যাওয়ার ৩ ঘন্টা আগে খাবার খাওয়া ও আধঘন্টা আগে ডিজিটাল ডিভাইসগুলো দূরে সরিয়ে ফেলা এবং যদি ৫-১০ মিনিটের বসে হালকা কোনো মেডিটেশন করা যায়। তাহলে ভালো ঘুম হতে বাধ্য।

যদি ৭ দিন বা এর বেশি সময় নিয়মিত ঘুম না হয় তবে অবশ্যই কোনো ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ নিতে হবে। এবং, সে মোতাবেক চলতে হবে। অপর্যাপ্ত ঘুম আমাদের মেজাজ খিটখিটে করে দেয়। খারাপ লাগা, হতাশা তৈরি করে।

৫. কাছের মানুষদের সাথে সময় কাটান

আমাদের পাশে যারা সবসময় থাকে, যারা আমাদের সাপোর্ট দেয়, যারা প্রতিদান কোন স্বার্থ ছাড়াই আমাদের মঙ্গল চায়, তারাই আমাদের কাছের মানুষ। বাকি সবার থেকে, তারা আমাদের ভালো বোঝে। এ জন্য তাদের সাথে সময় কাটানো খুব বেশি জরুরি।

যখন খুবই একাকিত্ব অনুভব হয়, তখন কাছের মানুষকে আপনার কথাগুলো শেয়ার করুন। তারা মনোযোগ দিয়ে আপনার কথা শুনবে, বোঝার চেষ্টা করবে এবং সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করবে। নিজের মধ্যে কষ্টগুলো জমা রেখে কখনো শান্তিতে থাকতে পারবেন না। সেগুলো ধীরে ধীরে ডিপ্রেশড করে দিবে আপনাকে। তাই শেয়ার করতে শিখুন।

৬. নেতিবাচক মানুষদের দূরে সরান

বর্তমান সময় আমাদের চারপাশে অহরহ নেতিবাচক মানুষ দেখা যায়। এরা কখনো আমাদের প্রেরণা দেয় না। বরং কিভাবে প্রেরণা নষ্ট করা যায়, দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়া যায়, সে পরিকল্পনায় এরা মগ্ন থাকে। এরা আবর্জনা-জঞ্জালের মতো। এদেরকে যতো জলদি সম্ভব জীবন থেকে সরানো উচিত। তবেই আমরা অনেক বেশি পসিটিভ অনুভব করবো।

তাই এদের এড়িয়ে চলতে শিখুন। যে মানুষদের সাথে কথা বললে আপনার অনুপ্রেরণা নষ্ট হয়ে যায়, তারা আর যাই হোক; আপনার জন্য মঙ্গলময় হতে পারে না। তাই এদের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত রাখারও কোনো দরকার নেই।

৭. একা থাকতে শিখুন

জীবন তখনই সুন্দর হয় যখন মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়। নিজেকে নিয়ে খুশি থাকতে পারে। আর যে নিজেকে খুশি রাখতে পারে, সে অন্যদেরও হাঁসিখুসি রাখতে পারে। আমাদের জন্মের সময় একা পৃথিবীতে আসতে হয় এবং মৃত্যুর সময়ও একাই যেতে হয়।

আমাদের কিছু হলে, সত্যিকার অর্থে কারো কিচ্ছু যায় আসে না । পরিবার হয়তো কিছুদিন কান্নাকাটি করে, কিন্তু কোনো একসময় তারাও ভুলে যেতে শুরু করে এবং ভুলেও যায়।

জীবন সম্পূর্ণ নিজের!

এখানে কেউ কারো পরোয়া করে না। তাই নিজের জন্য হলেও বেঁচে থাকতে শিখুন।।

মানুষের জন্য কিছু করতে শিখুন। অপরকে হাঁসান, নিজে প্রাণ খুলে হাঁসুন। প্রত্যেকটা প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে হবে। আর কখন কার ডাক এসে যায়, কেউ জানে না! তাই যতোটুক সময় আছেন, নিজের জন্য বাঁচুন। অপরকে ভালো রাখার জন্য বাঁচুন।

যতো বেশি সম্ভব হয় ভালো কাজ করুন। কারন পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পর আমাদের কর্মগুলো কিন্তু বেঁচে থাকে আমাদের স্বনামে, পরিচিতি বহন করে।

পৃথিবীর কেউই স্বয়ং-সম্পূর্ন না! সবারই অনেক চাওয়া পাওয়া আছে। না পাওয়া আছে। তারপরও অনেকে বিন্দাস লাইফ কাটাচ্ছে। কারণ তারা পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিতে শিখে গেছে। নিজেকে ভালোবাসতে শিখে গেছে।

তাই সবার আগে নিজেকে জানুন, নিজেকে ভালোবাসুন। কারণ, একমাত্র সৃষ্টিকর্তা এবং আপনি আপনার লাইফ চ্যাঞ্জার। আর কেউ কখনোই কিছু করতে পারবে না। তাই এসব হতাশা, বাজে চিন্তা, রাগ, ক্ষোভ ইত্যাদি ঝেড়ে ফেলুন।
নিজের জন্য বাঁচুন, জীবন অনেক বেশি সুন্দর হয়ে যাবে।

সম্পাদকের বাছাই –

Leave a Comment