ডায়বেটিস একটি বিপাকীয় প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট রোগ। এর কারণে দেহ ইনসুলিন উৎপাদন অক্ষম হয়ে যায় অথবা অধিক মাত্রায় ইনসুলিন প্রত্যাখ্যান করে। যার কারণে রক্তে সুগারের মাত্রা বেরে যায় অস্বাভাবিক পরিমাণে। এবং, এরই প্রেক্ষিতে ঘন ঘন প্রস্রাব, ক্লান্তি, ক্ষত, শুকাতে অধিক সময় নেওয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষনসমুহ দেখা যায়।
ডায়বেটিস এমন একটি রোগ যা কখনো সম্পুর্ণ নিরাময় হয় না। কিছু নিয়ম বা উপায় আছে যেগুলো অনুসরণ করে চললে এর থেকে বেঁচে থাকা যায়। নিচে উপায়গুলো দেওয়া হলোঃ-
ডায়বেটিস প্রতিরোধের প্রধান উপায় – ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
অধিক ওজন রোগ-বালাইয়ের কারখানা বলা যেতে পারে। নানাবিধ রোগের পাশাপাশি অধিক ওজন ডায়বেটিসও ডেকে আনে! দেহের ওজন স্বাস্থ্যকর পর্যায়ে না আনলে খুব সহজেই ডায়বেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
ডায়বেটিস থেকে বেঁচে থাকতে হলে সবার আগে ওজন নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এর জন্য অনেকেই ভেবে বসে থাকে রোগা পাতলা হলে বুঝি ডায়বেটিস ধরবে না তাদের। বিষয়টা কিন্তু মোটেও তেমন না।
ডায়বেটিস থেকে বেঁচে থাকতে হলে দেহের স্বাস্থ্যকর গঠন বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ অধিক মোটাও না অধিক রোগাও না। বজায় রাখতে হবে মধ্যম স্বাস্থ্যসম্মত গড়ন।
সবজি ও আঁশযুক্ত খাবার খান
সবুজ শাক ও সবজি বেশি বেশি খান। খাবারের তালিকায় গাজর, শশা, টমেটো বেশি বেশি রাখুন। অথবা, সালাদ বানিয়ে খেতে পারেন। সালাদে কিছু ভিনেগার যুক্ত করে দিলে আরো ভালো হয়। ভিনেগারের ফলে রক্ত কম সুগার শোষণ করে।
সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকলে ডায়বেটিসের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। যে খাবারগুলোতে আঁশ আছে সেগুলো বেশি বেশি খান। যেমনঃ- বাদাম, ভুট্টা, বার্লি, ওটমিল, খেজুর, মিষ্টি আলু, ছোলা, মসুর ডাল, ইত্যাদি।
আঁশ সমৃদ্ধ খাবার রক্তে সুগারের মাত্রা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। যার ফলে ডায়বেটিসের ঝুঁকিও অনেকাংশে কমে যায়।
ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
রক্তে চর্বি বিভিন্ন রূপে থাকে। সেগুলোর একটির নাম হলো ট্রাইগ্লিসারাইড। এটি মুলত এক ধরনের চর্বি। খাবার গ্রহনের ফলে উৎপন্ন বাড়তি ক্যালরি শরীর ট্রাইগ্লিসারাইডে রুপান্তর করে মেদকোষে জমা রাখে। এবং, পরবর্তীতে ট্রাইগ্লিসারাইড শরীরে শক্তির চাহিদা মেটায়।
এর মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক হলে অনেক সমস্যা হয়। যে সমস্ত খাবার ট্রাইগ্লিসারাইড এর মাত্রা বাড়ায় সেগুলো হলোঃ- মিষ্টি জাতীয় খাবার অধিক খাওয়া, ভাত, তেল ও চর্বিজাতীয় খাবার, কায়িক শ্রমের অভাব, লিভারের অসুখ, ধুমপান, অ্যালকোহল, মানসিক চাপ, ইত্যাদি।
উক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে খাদ্যাভ্যাস পরিচালনা করতে হবে। দারুচিনি পাউডার বা তেল নিয়মিত খাদ্য তালিকায় রাখলে ট্রাইগ্লিসারাইড এর মাত্রা অনেকাংশে কমে যায়। ট্রাইগ্লিসারাইড এর মাত্রা কমাতে পারলে ডায়বেটিস এর মাত্রাও কমে আসে।
ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায়সমুহ
নিয়মিত ব্যায়াম করুন
ডায়বেটিস হলো মেটাবলিক ডিজওর্ডার। শর্করা বিপাকজনিত কারনে এটি হয়। নিয়মিত ব্যায়াম করলে হরমোনেরজনিত অস্বাভাবিক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। ডায়বেটিস রোগী কতটা ভালো বা সুস্থ্য থাকবে সেটা তার সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের উপর নির্ভর করে।
ব্যায়ামের ফলে শুধু ডায়বেটিস নয় আরো অনেক রোগ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব। ব্যায়াম করলে যে উপকারগুলো পাওয়া যায় সেগুলো হলোঃ
- ব্যায়াম করার ফলে শক্তি ব্যয় হয়। যার কারনে শরীরের চর্বি কমে ও ওজন কম থাকে।
- ব্যায়ামের ফলে অগ্নাশয়ের সেল থেকে ইনসুলিন তৈরি বৃদ্ধি পায়।
- শরীরের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়।
- রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমায় ও ভালো কোলেস্টেরল এর মাত্রা বাড়ায়।
- উচ্চ রক্ত চাপ কমায়।
- হাড় ও হৃদপিন্ড ভালো থাকে।
- মনকে সতেজ ও প্রফুল্ল রাখে।
নিয়মিত ব্যায়াম রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রন করে। তাই সুস্থ্য জীবনযাপন ও ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখতে হলে ব্যয়ামের বিকল্প নেই।
ডিম খান
ডিমে রয়েছে ভিটামিন এ, বি টু, ও ডি। ডিম খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। এছাড়াও প্রোটিনের বৃহৎ উৎস হলো ডিম। ডিমে ওমেগা থ্রি থাকে; যা ডায়বেটিস আক্রান্তদের জন্য অনেক বেশি উপকারী।
ডায়বেটিস রোগীরা ডিম খাওয়ার আগের দিন সেটা ভিনেগারে ডুবিয়ে রেখে পরদিন খেলে চিন্তামুক্ত থাকা যায় ও বেশি উপকার পাওয়া যায়। তাই ডায়বেটিস আক্রান্তরা প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। ডিম সিদ্ধর সাথে সামান্য দারুচিনি গুড়ো ছিটিয়ে খেলে আরো বেশি উপকার পাওয়া যায়। দারুচিনি ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ ডিম শরীরে গুড কোলেস্টেরল তৈরি করে। তাই কোলেস্টেরল ও ইনসুলিনের ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রতিদিন একটি করে ডিম খান।
ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে যে ফলগুলো নিয়মিত খাবেন
পেঁপেঃ
পেঁপেতে মিনারেল ও প্রচুর ভিটামিন রয়েছে। যা ডায়বেটিস রোগীদের জন্য খুবই উপকারী। কাঁচা-পাকা উভয় পেঁপেই খেতে পারেন। তবে পাকা পেঁপে পরিমাণ অনুযায়ী খেতে হবে।
পেয়ারাঃ
পেয়ারাতে রয়েছে ডায়াটারি ফাইবার ও ভিটামিন সি, এ। এগুলো ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে থাকে। এছাড়াও ডায়বেটিস হওয়ার আশংকা অনেকাংশে কমায় এই ফলটি।
আপেলঃ
আপেলে রয়েছে পেকটিন, যা শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ ভুমিকা পালন করে। তাছাড়াও এতে থাকা ফাইবার ডায়বেটিস রুগিদের জন্য অনেক উপকারী। ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতেও এর গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে।
আমলকিঃ
আমলকিতে আছে ক্রোমিয়াম ও প্রচুর ভিটামিন সি। ক্রোমিয়াম অগ্নাশয়ের জন্য অনেক উপকারী। এটি ইনসুলিন ও শর্করার মাত্রা বজায় রাখে এবং চিনির মাত্রা বজায় রাখে। ডায়বেটিসে আক্রান্ত হলে অবশ্যই দিনে ২-৩ টি আমলকি খান।
কমলাঃ
কমলাতে থাকা ভিটামিন সি ও ম্যাগনেসিয়াম ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে। তাই দৈনিক খাবার তালিকায় কমলা রাখুন।
খেজুরঃ
খেজুর সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করে। নিয়মিত খেজুর খেলে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে; যা ডায়বেটিস রোগীদের জন্য অনেক উপকারী।
ডায়বেটিস রোগীরা যে সবজিগুলো বেশি বেশি খাবেন
পালংশাকঃ
পালংশাকে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। পালংশাক অতি পুষ্টিকর একটি শাক। এটি অল্প সিদ্ধ করে খেলে বেশি উপকার পাওয়া যায়। ডায়বেটিস রোগীদের নিয়মিত পালংশাক খাওয়া উচিত।
বাঁধাকপিঃ
বাঁধাকপিতে শর্করা পরিমাণ খুব বেশি। এটি টাইপ ১ রোগীদের শর্করা সঠিক মাত্রায় বজায় রাখে ও টাইপ ২ রোগীদের ডায়বেটিসের ঝুঁকিসমুহ হ্রাস করে।
করলাঃ
করলা ইনসুলিনের পরিমান কমিয়ে রক্ত থেকে শরীরের কোষগুলোর সুগার গ্রহনের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি গ্লুকোজের বিপাক ক্রিয়া বাড়িয়ে দেয়। রক্তে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত করলা খান।
ক্যাপসিকামঃ
ক্যাপসিকাম হজম শক্তি উন্নত করে। দ্রুত ওজন কমাতেও সহায়ক। এটি শর্করার মাত্রা স্থির রাখে। তাই খাবার তালিকায় পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ ক্যাপসিকাম অবশ্যই রাখুন।
টমেটোঃ
টমেটো ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখে। টমেটোতে থাকা ক্রোমিয়াম রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
ঢেড়সঃ
ঢেড়সে রয়েছে উপকারী ফাইবার, যা দেহের গ্লুকোজের মাত্রা কমায়। ডায়বেটিস রোগীদের জন্য ঢেড়স খুবই উপকারী।
গাজরঃ
গাজরে থাকা কোলেস্টেরল ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে। গাজর চর্বি কমাতে সাহায্য করে। এতে ক্যলরি ও সুগারের পরিমান খুবই কম থাকে। ডায়বেটিস প্রতিরোধকারী ভিটামিন ও খনিজ গাজরে বিদ্যমান।
মটরশুঁটিঃ
মটরশুঁটিতে রয়েছে ফাইবার যা ডায়বেটিস রোগীদের জন্য অনেক উপকারী। এটি রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
ডায়বেটিস এমন একটি রোগ যা কখনোই সম্পুর্ণ নিরাময় করা যায় না। বিশ্বের চল্লিশোর্ধ অধিকাংশ মানুষ এই রোগটিতে আক্রান্ত। ডায়বেটিস হলে শরীরে নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। যার ফলে এটি নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরী।
উপরোক্ত বিষয়গুলো মেনে চললে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে আসবে। এবং, নানা জটিল সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। যাদের ডায়বেটিস হয়নি তারা উক্ত বিষয়গুলো অনুসরণ করলে ডায়বেটিস প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবেন; যদি না বংশে কারো ডায়বেটিস থাকে।
Featured Photo by Towfiqu barbhuiya on Unsplash
প্রাসঙ্গিক লেখাসমূহ-