গবেষণা মতে ৩৫ লক্ষ পুরুষ ও ২১ লক্ষ নারী চুল পড়ার সমস্যায় ভুগছেন। চুল পড়ার সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের আজকের আলোচনায় চুল পড়ার কারণ ও ঘন, কালো, ঝলমলে চুল পাবার উপায় সমূহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
এটি বর্তমানে সাধারণ বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। তবে এটি অনেকসময় অসুস্থতার লক্ষন হিসেবে দেখা দেয়। আবার অনেক সময় আমাদের হীনমন্যতায় ভোগায়। অনেকেই আছে যাদের কোনো এক সময় ঘন স্বাস্থ্যজ্জ্বল চুল ছিলো। কিন্তু তা পরতে পরতে এখন একদম পাতলা হয়ে গেছে। আবার অনেকেরই জন্মগত ভাবেই চুল পাতলা। তারপরও হেয়ার ফল (চুল পড়া) এর সমস্যা রয়েছে।
আমেরিকান একাডেমি অফ ডারমেটলজিস্ট এর রিসার্চ মতে প্রতিদিন ৫০-১০০টি চুল পরা স্বাভাবিক। এতে ভয়ের কিছু নেই। তবে আপনার যদি দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টি চুল পড়ে তাহলে সেটি চিন্তার বিষয়।
ঘন কালো ঝলমলে চুল পাওয়ার কৌশল গুলো জানার আগে কেনো চুল পরে সে বিষয় সচ্ছ্ব ধারণা থাকা দরকার। চুল পড়ার জন্য দায়ী কারণগুলো জানলে খুব সহজেই চুল পড়া নিয়ন্ত্রণ করে ঘন চুলের অধিকারী হতে পারবেন।
আরও পড়ুন-
তাহলে আসুন প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, কেনো চুল পরে সেই কারণগুলো –
হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে চুল পড়া
হরমোনের তারতম্য হলে চুল পড়া দেখা দেয়। বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি বেশি দেখা দেয়। জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খাওয়া বন্ধ করে দিলে এমনটা হতে পারে। আবার অনেক সময় গর্ভাবস্থায় দেহে হরমোনের তারতম্য ঘটে। যার কারণে অনেক বেশি চুল পড়তে পারে। মহিলাদের রজঃনিবৃত্তি বা পিরিয়ড বন্ধ হওয়ার পরও চুল পড়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
কেমিক্যালযুক্ত হেয়ারকেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার করার কারণে চুল পড়া
বিভিন্ন হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টে এসএলএস (সোডিয়াম লরেট সালফেট) , প্যারাবেন, ইত্যাদি রাসায়নিক দ্রব্য অধিক ব্যবহার করা হয়। যা চুল পরার জন্য দায়ী! মূলত এসব রাসায়নিক দ্রব্য ছাড়া বেশিরভাগ হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্ট তৈরী হয় না। হেয়ার ফল হওয়ার এটাও একটা বড় কারণ।
থাইরয়েড জনিত সমস্যা : চুল পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ
থাইরয়েড হলো অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি; যেটা আমাদের গলায় থাকে। এই থাইরয়েড গ্রন্থি থেকেই থাইরয়েড হরমোন নিঃসৃত হয়। এ হরমোন আমাদের প্রোটিন সিন্থেসিস ও মেটাবলিক রেটকে প্রভাবিত করে।
নির্দিষ্ট মাত্রার কম বা বেশি পরিমাণ থাইরয়েড হরমোন নিঃসৃত হলেই তাকে থাইরয়েড সমস্যা বলে। থাইরয়েডজনিত সমস্যা দেখা দিলে দেহের পাশাপাশি চুলেও প্রভাব পরে। যার কারণে চুল পাতলা হয়ে যেতে পারে।
অনিদ্রা ও স্ট্রেস : চুল পড়ার কারণ সমূহের মধ্যে একটি
অনিদ্রা বা পরিমাণ মতো ঘুম না হওয়ার ফলে, আমাদের দেহে যেমন বিরুপ প্রভাব পরে, ঠিক তেমনি আমাদের চুলেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। রাত জেগে সোশ্যাল মিডিয়া ও নেটফ্লিক্স দেখার হার বাড়ার সাথে সাথে বর্তমানে অনিদ্রার সমস্যাও প্রকোপ হয়েছে। যার ফলে দেহের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে ও স্ট্রেস বা মানসিক চাপ বাড়ছে।
বর্তমান জেনারেশনের হেয়ার ফল বা চুল পড়ার জন্য দায়ী বড় একটি কারণ হলো অনিদ্রা ও স্ট্রেস। বর্তমানে বৃহৎ অংশ মানুষ অনিদ্রার শিকার। আর সাথে কর্মব্যস্ত জীবনের স্ট্রেস তো আছেই। এই দুইটার সম্মিলনে চুল পড়ার সমস্যা দেখা দিতে বাধ্য।
ডায়েট ও অপুষ্টির কারণে চুল পড়া
ফিট বা শরীরের ওজন ঠিক রাখতে অনেকেই ডায়েট করে থাকেন। ডায়েট করার মূল উদ্দেশ্যই হলো সুস্থ্য থাকা। তবে এটা করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়ে যায় অনেক সময়।
ডায়েট করতে গিয়ে ভিটামিন ও মিনারেল যুক্ত খাবার খাদ্য তালিকা থেকে বাদ পরে যায়। যা চুল পড়ার অন্যতম একটি কারণ। দেহে যে পরিমাণ ভিটামিন ও মিনারেল প্রয়োজন তা যদি সরবরাহ করা না হয় তাহলে অনিবার্য কারণেই আপনার চুল পড়বে।
ধূমপান জনিত কারণে চুল পড়া
আমাদের চুলের গোড়ায় অতি সূক্ষ সূক্ষ রক্তনালী রয়েছে। এসব রক্তনালির সাহায্যে চুল প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়। ধূমপান করলে এসব রক্তনালি গুলো বন্ধ হয়ে যায়। যার কারণে চুল প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না।
ঠিক এই কারণে ধূমপান করাকে হেয়ার ফল বা চুল পড়ার জন্য দায়ী কারণগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে গণ্য করা হয়। মেয়েদের তূলনায় ধূমপানজনিত হেয়ার ফল সমস্যাটি পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রবল। কারণ তারা অধিক হারে ধূমপান করে।
উপরোক্ত বিষয়গুলো এড়িয়ে চললে খুব সহজেই চুল পড়া কমাতে পারবেন। এখন চলুন জেনে নেওয়া যাক-
ঘন কালো ঝলমলে চুল পেতে করণীয় কি?
০১। ঘন চুল পেতে সঠিক নিয়মে তেল ব্যবহার করুন
চুলের যত্নে সবার প্রথমেই মাথায় আসে তেলের কথা। স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ঘন কালো পাবার জন্য তেলের বিকল্প নেই। তেল চুলে পুষ্টি যুগিয়ে চুলের গোড়া মজবুত করে এবং চুলকে করে ঘন, কালো ও লম্বা।
ঘন, কালো ও সুন্দর চুল পেতে তেল অতুলনীয়। তবে চিপচিপে করে মাথা ভর্তি তেল দিয়ে দিনের পর দিন পাড় করা জনগণের সংখ্যা বৃহৎ। তাদের ধারণা মাথায় বেশি দিন তেল রাখলে চুল বেশি পুষ্টি পাবে। যার ফলে চুল বেশি ঘন হবে। বেশি ভালো থাকবে ইত্যাদি, ইত্যাদি। যা পুরোপুরি ভ্রান্ত বিশ্বাস!
আমাদের চুল মূলত একধরনের মৃত কোষ। চুলের গোড়ায় সিবাম নামক গ্রন্থি থাকে। যা থেকে প্রাকৃতিক তেল নিঃসরণ হয়। যা চুলকে পুষ্টি দিয়ে চুলকে শুষ্ক ও ভঙ্গুর হওয়া থেকে রক্ষা করে।
মাথায় অধিক তেল ব্যবহার করলে ও বেশিক্ষণ তেল দিয়ে রাখলে চুল অনেক বেশি দুর্বল হয়ে যায়। এতে করে মাথায় ময়লা জমতে শুরু করে। এসব ময়লা মাথায় আস্তরণের মতো তৈরি করে। যার কারনে মাথার ক্ষুদ্র রন্ধ্র গুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলস্বরূপ চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়।
এতে করে চুল ঘন হওয়ার পরিবর্তে পাতলা হতে শুরু করে এবং খুশকি, হেয়ার ফল আপনার পিছু ছাড়ে না। ঘন, কালো সুন্দর চুল পেতে ৬-৮ ঘন্টার বেশি তেল রাখবেন না মাথায়। অয়েল ম্যাসাজ করার পরপরই চুল আচড়াতে যাবেন না। কারণ তেল দেওয়ার সময় যথেষ্ট ম্যাসাজ করা হয়েছে।
তেল দেওয়ার ফলে চুলের গোড়া নরম যায় এবং ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে। সে সময় চুল আচড়ালে চুল গোড়া থেকে উঠে আসে। তেল দেওয়ার আগে সহনীয় মাত্রায় গরম করে নিন এবং ৬-৮ ঘন্টা রেখে শ্যাম্পু করে ফেলুন। এতে করে চুল ময়েশ্চারাইজড থাকবে।
০২। ঘন চুল পেতে ন্যাচারাল হেয়ার প্যাক ব্যবহার করুন
কেমিক্যাল যুক্ত দ্রবাদি ব্যবহার করতে করতে স্বাস্থ্যের নাজেহাল দশা বানিয়ে এখন আমরা ন্যাচারাল প্রোডাক্টের গুরুত্ব হারে হারে টের পাই। যতোই দামি দামি বিউটি পার্লারে গিয়ে হেয়ার স্পা করুন না কেনো, ন্যাচারাল প্রোডাক্টের কাছে হার মানতেই হবে!
হেয়ার ফল থেকে বাঁচতে ও ঘন ঝলমলে চুল পেতে ন্যাচারাল হেয়ার প্যাকই প্রথম ভরসা। ন্যাচারাল হেয়ার প্যাকের মধ্যে রয়েছে – নীম পাউডার, আমলকি পাউডার, ঘৃতকুমারী পাউডার, মেহেদী পাউডার, থানকুনি পাউডার, ব্রাহ্মী পাউডার, জবা ফুল পাউডার ইত্যাদি।
পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু হেয়ার প্যাকের কথা বললাম। আরো অনেক ধরনের হেয়ার প্যাক বাজারে পাওয়া যায়। একটু খোঁজ করলেই আশেপাশের কসমেটিক দোকানে এগুলো পেয়ে যাবেন। সেখানে না পেলে অনলাইন থেকে অর্ডার করতে পারেন।
খুবই সাশ্রয়ী মূল্যে এইসব হেয়ার প্যাক পেয়ে যাবেন। এগুলো ব্যবহার করলে প্রাকৃতিকভাবেই আপনার চুল পড়া বন্ধ হবে। চুলের গোঁড়া মজবুত হবে ও চুল ঘন, কালো, ঝলমলে হবে।
০৩। ঘন, কালো চুল পেতে চুলে ঘরোয়া উপাদান ব্যবহার করুন
ঘন চুলের জন্য মাথা ভর্তি কেমিক্যাল ব্যবহার করে পরে ঠিকই চুল বিশেষজ্ঞর কাছে দৌড়তে হয়েছে; এমন ঘটনা অহড়হ দেখা যায়। অথচ আপনার আশেপাশেই রয়েছে হেয়ার কেয়ার ইনগ্রিডিয়েন্ট বা চুল যত্নে উপকারী প্রাকৃতিক উপাদান। হাতের কাছেই যদি প্রতিষেধক থাকে তাহলে কেনো বাড়তি ঝামেলা নিতে যাবেন?
হ্যাঁ, এখন বলছি ঘরোয়া কিছু কার্যকরী উপাদানের কথা। আমাদের সবার বাড়িতেই কমবেশি অ্যালোভেরা, আমলকি, পেঁয়াজ, মেথি, মেহেদী, মধু, লেবু, ডিম, অলিভ অয়েল, কোকোনাট অয়েল; এগুলো রয়েছে। এগুলো দিয়ে খুব সহজেই হেয়ার মাস্ক তৈরি করে নিতে পারেন। এই হেয়ার মাস্ক গুলো সপ্তাহে ২ দিন ব্যবহার করলেই আপনার চুল প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাবে এবং মজবুত ও ঘন হতে শুরু করবে।
ঘন, কালো ঝলমলে চুলের জন্য ঘরোয়া উপাদানে কিছু হেয়ার মাস্ক তৈরির পদ্ধতি
০১। ৩-৪ টি আমলকি, ১টি মিডিয়াম সাইজের পেয়াজ ভালোভাবে ব্লেন্ড করে নিন। এবার এই মিশ্রণে যোগ করুন ৩ টেবিল চামচ খাঁটি নারিকেল তেল। সবকিছু ভালোভাবে মেশানো হয়ে গেলে অল্প করে আঙুলের ডগায় নিয়ে আলতো করে চুলের ডগায় ম্যাসাজ করুন।
১০ মিনিটের মতো ম্যাসাজ করে ১ ঘন্টা অপেক্ষা করুন। ১ ঘন্টা পর শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে নিন। সপ্তাহে ২দিন এই হেয়ার মাস্কটি ব্যবহার করুন। এক্ষেত্রে ন্যাচারাল শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারলে বেশি ভালো ফলাফল পাবেন।
০২। সতেজ অ্যালোভেরা থেকে ৩ টেবিল চামচ জেল বের করে নিন। ৫০-৬০ গ্রাম সতেজ মেহেদী পাতা, ৪টি আমলকি একত্রে ব্লেন্ড করুন। এই হেয়ার প্যাকটি মাথায় ১ ঘন্টার মতো লাগিয়ে রাখুন। এরপর ভালোভাবে চুল ধুয়ে নিন। মেহেদীর গন্ধ সহ্য না হলে শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে নিতে পারেন। তবে শ্যাম্পু ব্যবহার না করলেই ভালো হয়।
০৩। বাটিতে ১টি ডিম ফাটিয়ে নিন। এবার এতে যোগ করুন ৩ চামচ লেবুর রস, ১চামচ মধু ও ৩ চামচ এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল। উপকরণগুলো ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। এবার এই হেয়ার প্যাকটি ভালোভাবে মাথায় লাগিয়ে ৪৫-৬০ মিনিটের মতো অপেক্ষা করে শ্যাম্পু করে নিন। এই হেয়ার মাস্কটি আপনার চুলে ইন্সট্যান্ট গ্লিটার এনে দিবে এবং নিয়মিত ব্যবহারে চুলকে ঘন ও মজবুত করবে।
চুলের প্রতি যত্নশীল হন। চুল নিয়ে বেশি ঘষাঘষি বা আচড়াতে যাবেন না। যত্নের সাথে পরিচর্যা করুন। উপরের পদ্ধতিগুলো মেনে চলুন ও বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার খান। ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহারের উপর জোর দিন। এগুলো মেনে চললে অবশ্যই আপনি স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ঘন, কালো ঝলমলে চুলের অধিকারী হতে পারবেন।
প্রয়োজন মনে হলে পড়ে দেখতে পারেন-