কে না চায় কিছুটা সুখী জীবনযাপন করতে ! কিন্তু সুখ সে তো আলাদিনের চেরাগের মত, সবার হাতে ধরা দেয় না। ধরা না দিলেও আমরাই পারি নিজেদের হতাশা থেকে দূরে রাখতে।
আমরা সকলেই জীবনে কখনও না কখনও অবসাদে ভুগেছি। কখনও কাজের চাপে অবসাদ। কখনও চাকরি না পাওয়ার অবসাদ। কখনও বৈবাহিক জীবনে অশান্তির কারণ আসা অবসাদ। কখনও বা জীবনে উপযুক্ত সঙ্গী না পাওয়ার অবসাদ। কখনও অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়ার ভয়। হতাশা থেকে আসা অবসাদ।
তাছাড়া করোনার কারণে ঘরবন্দী থেকে অনেকেই হাঁপিয়ে উঠেছিলো। বিশেষ করে স্কুল কলেজগামী ছাত্রছাত্রীরা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাড়িতে বসে বিরক্ত হয়ে উঠছে।
গত বছরে ঘটে যাওয়া অধিকাংশ আত্মহত্যার ঘটনা অবসাদ থেকেই ঘটেছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী ২৬ মিলিয়নেরও বেশি লোক হতাশায় প্রভাবিত হয়। ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষ হতাশায় ভোগে।
হতাশার কারণ?
জীবনের অনেক ধাপেই দেখা দিতে পারে হতাশা। প্রতিটি মানুষই হতাশ হয়। কেউ বেশি, কেউ কম। কেউ কেউ মানসিক ভাবে শক্ত হওয়ায় নিজেকে খুব সহজেই সামলে নিতে পারে। কাছের সম্পর্ক গুলোর কারণে মানুষ হতাশ হয়।
অনেক সময় নানান সামাজিক কারণে মেয়েদের যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, সেগুলোও হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন- ছেলেদের বেকারত্ব, পারিবারিক অশান্তি, নিজের অনুভূতি গুলো বুঝাতে ব্যর্থ হলে, আর্থিক সমস্যায়, কাছের মানুষের বিচ্ছেদের কারণে, পড়াশোনার চাপে মানুষ হতাশায় ভোগে। পাশাপাশি বয়ঃসন্ধিকালে যারা পা রাখে, সবারই প্রথম প্রথম নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।
অনেকে সেই পরিস্থিতিতে সহজে মানিয়ে নিতে পারে না। সেই সাথে পরিবর্তন হয় মানসিক চিন্তা ধারার। এসব থেকে বেশিরভাগ কিশোর কিশোরী আক্রান্ত হয় হতাশায়।
একটি সাধারণ ঘটনা পর্যবেক্ষন করলে বিষয়টা বুঝতে পারবো। মানুষের মৃত্যু কিংবা চলে যাওয়াতে আমাদের কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই কষ্টটার সময়কাল যদি ৫ – ৬ মাস কিংবা ১ বছরে রূপ নেয় তবে ধরে নিতে হবে মানুষটি হতাশায় ভুগছে।
আবার, ছোট বাচ্চারাও মানসিক অবসাদে ভোগান্তির স্বীকার হতে পারে। মা বাবার কলহ, মা বাবা থেকে দূরে থাকা, অকারণে মা বাবার শাসনের উপর থাকা, স্নেহ ভালোবাসার ঘাটতি এসব হতে পারে একজন ৭ থেকে ৮ বছরের বাচ্চাদের হতাশার কারণ।
হতাশা কাটিয়ে উঠতে করণীয়
নিজেকে সময় দিনঃ
বেশির ভাগ হতাশার কারণ হচ্ছে নিজের তুলনায় অন্যকে নিয়ে বেশি ভাবা৷ মানুষ নিজের থেকে ভাবে বেশি কাছের মানুষদের নিয়ে। তাই তাদের থেকে প্রাপ্য সামান্য দুঃখটুকুই অনেক সময় রূপ নেয় হতাশায়। হতাশা থেকে দূরে থাকতে হলে ভাবতে হবে নিজেকে নিয়ে। কিভাবে নিজেকে ভালো রাখা যায় সেটা নিয়ে।
গান শুনুনঃ
গান শুনতে সবারই ভালো লাগার কথা। এর পিছনেও রয়েছে বৈজ্ঞানিক কারণ। গানে এনড্রোফিন ও অক্সিটোসিনের মতো মনকে চনমনে রাখা এবং পরমার্থিকতা বাড়ানো সুখী হরমোন নিঃসরণ হয়। যার ফলে উদ্বেগ ও চাপ কমে। গান একা থাকার প্রবণতা কমায়। এবং মানসিক দুশ্চিন্তা দূর করে। তবে গানের ধরণ অবশ্যই শ্রুতিমধূর হতে হবে।
কষ্টে মনমরা গান শুনলে বাজে প্রভাবই বেশি পরতে পারে। আর চেষ্টা করুন নিজে গুনগুনিয়ে গান গাইতে। যেকোনো কাজ করতে করতে গান গাইতে পারলে বাজে চিন্তা ভাবনা গুলো থেকে নিজেকে কিছুটা হলেও সরিয়ে আনা সম্ভব।
ব্যস্ত থাকুন কাজেঃ
কথায় আছে “অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা “। সারাদিন ঘরে কোনো কাজ ছাড়া বসে থাকলে কুবুদ্ধি চেপে বসে মাথায়। এতে শুরু হয় নানান দুশ্চিন্তা। যা অপ্রয়োজনীয়, তা নিয়েও ভাবতে শুরু করে তখন। ঘরোয়া কাজ কিংবা বই পড়া, শিক্ষামূলক মুভি দেখা এসব নিয়েও ব্যস্ত থাকা যায়। এতে হতাশা দূর হয়ে যায়।
ভ্রমণ করাঃ
মনোবিজ্ঞানীরা হতাশাগ্রস্ত মানুষদের জন্য ভ্রমণটাও ট্রিটমেন্টে রাখে। সবুজ পরিবেশে ঘুরাফেরা করলে মনে প্রফুল্লতা আসে। সম্প্রতি কানাডিয়ান গবেষকদের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যখন মানুষ প্রকৃতির মধ্যে থেকে ফুল, পাখি, গাছ, নীল আকাশ দেখে, তখন এই প্রকৃতি, পরিবেশ তার মধ্যে সুখানুভূতির সৃষ্টি করে। পাহাড়, পর্বত, সাগর, নদী এসব কিছু মানুষের মনে উদারতা নিয়ে আসে।
নিয়মমাফিক ঘুমঃ
প্রত্যেকটা মানুষেরই পর্যাপ্ত ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। অপর্যাপ্ত এবং নিয়মমাফিক ঘুম না হলে দেখা দিতে পারে খিটখিটে মেজাজ ও উচ্চ রক্তচাপ। চিকিৎসকদের মতে একজন মানুষের দিনে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন। ঘুম চিন্তা দূর করে, মস্তিস্ক শীতল রাখে। এবং হতাশার কারণ গুলো থেকে দূরে রাখে। রাত জাগা অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।
মেডিটেশন ও ব্যায়ামাভ্যাসঃ
ব্যায়াম স্বাস্থ্যের পক্ষে যেমন উপকারী তেমন মনের ক্ষেত্রেও। দু’দিক থেকে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটায় ব্যায়াম। ব্যায়াম মানুষের মানসিক অবসাদ ও দুশ্চিন্তা দূর করে। শরীর ভালো থাকলে মনও ভালো থাকে। কার্নেগী মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে ২৫ মিনিট করে টানা ৩ দিন মেডিটেশন করলে তা হতাশা এবং দুশ্চিন্তা অনেকখানিই দূর করতে সহায়তা করে। তাই মেডিটেশন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ব্যায়াম।
কিছুটা হলেও আস্তে আস্তে শরীরচর্চার অভ্যাস গড়ে তুলা উচিত।
ক্রমাগত হতাশা ও দুশ্চিন্তা মানুষের ক্ষুধা, ঘুম ও খাওয়া দাওয়ার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এসব হতাশাকে প্রশয় দেয়া যাবে না। কেননা, যতই প্রশয় দেয়া হবে- হতাশা ততই মাথায় উঠতে থাকবে এবং বুদ্ধিনাশ করবে।
তাই নিজের চেষ্টাতেই দূর করতে হবে হতাশা, মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশনকে।
প্রাসঙ্গিক লেখা-