ড্রপশিপিং ব্যবসায়ের চারটি ধাপ সম্পর্কে জানুন

অনলাইনে ড্রপশিপিং ব্যবসা করে আয় করার কথা ভাবছেন? যদি উত্তরটি হ্যা হয়ে থাকে, তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়- আপনি ড্রপশিপিং ব্যবসা কি সে সম্পর্কে ধারণা কিছুটা অন্তত ধারণা নিয়েছেন। আমাদের পূর্ববর্তী লেখায় ড্রপশিপিং কি সে সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে ব্যখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ লেখাতে ড্রপশিপিং ব্যবসায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চারটি ধাপ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

একটি পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার কথা ভাবা যাক। তিনজনকে নিয়ে এই ব্যবস্থাটি তৈরি হয়। পণ্য প্রস্তুতকারী, পাইকারি বিক্রেতা এবং খুচরা ব্যবসায়ী। এই ধারায় পণ্যটি শেষ পর্যন্ত ভোক্তার কাছে পৌঁছায়। এখানে ড্রপশিপারকে দেখা যায় না। কারণ, পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় যে তিনজনের কথা বলা হল; প্রত্যেকেই একটি ভূমিকা পালন করেন এই ব্যবস্থায়। কিন্তু ড্রপশিপার সেই অর্থে কোন ভূমিকা পালন করেন না।

এখানেই কিছুটা বোঝা যায় যে, ড্রপশিপিং ব্যবসা পণ্যের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নয়। অর্থাৎ, ড্রপশিপিং কোন ভূমিকা নয় যেটি আপনি পালন করবেন। ড্রপশিপিং একটি সেবা। একজন ব্যবসায়ী এই সেবাটি দিয়ে থাকেন। সেবাটি হচ্ছে – পণ্য উৎপাদনকারীর সাথে ভোক্তার একটি সংযোগ তৈরি করে দেয়া। সেবাদানকারী ব্যবসায়ীই একজন ড্রপশিপার।

ড্রপশিপারের সেবার কারণে ভোক্তার বেশ কিছু সুবিধা হয়। তিনি মধ্যবর্তী-জন বা খাঁটি বাংলায় যাকে “দালাল” বলে যাকে; এমন বিবিধ মিডল-ম্যানকে, খারিয করে দিতে পারছেন। ফলে, সাধারণের চেয়ে আরও কম টাকায় তিনি পণ্যটি কিনতে পারছেন।

তবে সবক্ষেত্রেই যে ড্রপশিপার একজন উৎপাদনকারীর সাথেই ভোক্তাকে জুড়বেন এমন কিন্তু নয়। যে তিনজনের কথা বলা হল তাদের যে কারও সাথে ভোক্তাকে যুক্ত করতে পারেন একজন ড্রপশিপার।

যেমন ধরুন, একজন ড্রপশিপার দীর্ঘদিন ব্যবসা করছেন। ইতিমধ্যেই তিনি একটি ডেলিভারী ব্যবস্থা ব্যবহার করেন। তার পণ্য প্যাকিং করার প্রতিষ্ঠান আছে। পণ্য জমা রাখে এমন কোন স্টোরহাউজের সাথেও তিনি ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরি করেছেন।

এখানে ড্রপশিপারই কেন্দ্রীয়। অন্য সেবাগুলো তার সাপেক্ষে, তাকে কেন্দ্র করে বর্তমান। এমন একজন ড্রপশিপারের সাহায্যে পণ্য উৎপাদনকারী সহজেই তার নিজস্ব উৎপাদিত পণ্য বিক্রী করতে পারেন।

আবার একই কথা পাইকার ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে যেটা ঘটছে, ড্রপশিপারের সেবা ব্যবহার করে, সাপ্লাই-চেইনের এই তিনজনই একটি দালাল বিবর্জিত পরিবেশে ভোক্তার নাগাল পাচ্ছেন। ফলে, প্রত্যেকেই আরও কম দামে পণ্য বিক্রি করার সুযোগ পান।

মিডলম্যান এড়িয়ে ব্যবসা করাই ড্রপশিপিংয়ের মূলভাব। আপনার এবং পণ্য উৎপাদনকারীর মাঝে মিডলম্যানের সংখ্যা যত কম, আপনিও তত ভালো দামে পণ্য দিতে পারবেন ক্রেতাকে। আপনার মুনাফাও হবে বেশী। সামগ্রিকভাবে , আপনার ড্রপশিপিংয়ের উদ্যোগটি আপনার জন্য লাভজনক হবে।

ড্রপশিপিংয়ের ব্যবসাটি চারটি ধাপে সম্পন্ন হয়। এই ধাপগুলোকে বুঝলেই একজন সফল ড্রপশিপার হওয়ার সম্ভব আপনার পক্ষে।

প্রথম ধাপ : ক্রেতা অর্ডার দিবেন

একজন কাস্টমারের ড্রপশিপারের সাইটে গিয়ে অর্ডার দেন। এই কাজটি করা হয় মোবাইল বা পিসির মাধ্যমে। সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইলের মাধ্যমেই করা হয় বেশী। সুতরাং ড্রপশিপিংয়ের সাইটটির মোবাইল পেজটিকে মোবাইল বা ট্যাব ডিভাইসের জন্য অপরিমাইজ করুন।

ক্রেতার সুবিধার জন্য আপনার ড্রপশিপিংয়ের পেজের “কল-টু-একশান” বাটন, যেমন : “কল করুন” “মেসেজ দিন” “কিনুন” – এই অপশানগুলো স্পষ্ট ও সুবোধ্য হওয়া দরকার। পেজটির পেজ লোডিং টাইম যাতে দ্রুত হয় সেই দিকে খেয়াল রাখবেন। আপনার সাথে যোগাযোগের সব ধরণের উপায় পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করুন।

ক্রেতা অর্ডার দেয়ার পরই স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেটেড ইমেইল ব্যবস্থার মাধ্যমে ড্রপশিপার এবং ক্রেতা দু’জনই অর্ডারের নিশ্চিতকারী বা কনফার্মকারী ইমেইল পেয়ে থাকেন। ক্রেতা অর্ডারের টাকা দেয়ার সাথে সাথেই, আপনার দোকানের সফটওয়্যার সেটাকে গ্রহণ করে, এবং টাকা ড্রপশিপারের একাউন্টে জমা হয়। আবার, টাকা জমা দেওয়ার প্রক্রিয়াটির ব্যাপ্তি যদি কয়েক দিন হয়, সেক্ষেত্রে পণ্য পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করার আগে আরও একবার কনফার্ম করা হয়।

আপনি যদি, একজন ড্রপশিপার হয়ে থাকেন, তাহলে সবসময়ই পার্সোনাল কম্পিউটারের মাধ্যমে যোগাযোগ করবেন। মোবাইল যে এ্যপস-গুলো পাওয়া যায়, সেগুলোতে পিসির বহু সুবিধাই থাকে না। ফোন যন্ত্র হিসেবেও একটু সংকীর্ণ আকৃতির। সুতরাং অর্ডারগুলো নিয়ে কাজ করার সময় তালগোল পাকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আপনি চাইলে ল্যাপটপও ব্যবহার করতে পারেন। ল্যাপটপের বহনযোগ্যতা আছে।

খেয়াল রাখবেন আপনার ব্রাউজার যেন একদম নতুন ও আপডেটেড হয়। অনলাইনের বিভিন্ন হোলসেলার প্লাটফর্মগুলো যেসব প্লাগ-ইন ব্যবহার করে, সেজন্য নতুন ব্রাউজার থাকা জরুরী।

দ্বীতিয় ধাপ : সরবরাহকারীর সাথে যোগাযোগ করা

ড্রপশিপিং প্রক্রিয়ার দ্বীতিয় ধাপ সাপ্লাইয়ার বা পণ্য সরবরাহকারীদের সাথে যোগাযোগ করা। ড্রপশিপার তাদেরকে বার্তা পাঠাবেন যে ক্রেতা তার পছন্দনীয় পণ্য ক্রয় করার জন্য অর্ডার কনফার্ম করেছেন। ড্রপশিপার সরবরাহকারীর সেবা প্রদানের প্রতিটি বিষয়ে রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করে রাখবেন।

রেজিস্ট্রেশানের সময়ই পেইমেন্ট ডিটেলস বা টাকা পয়সা কিভাবে দেয়া হবে সেই বিষয়টির সুরাহা করা থাকে। ড্রপশিপার হয়তো ক্রেডিট কার্ড মারফত টাকা দেন। তাহলে, পণ্য সরবরাহকারী তখন ড্রপশিপারের ক্রেডিট কার্ড থেকে অর্ডারের পণ্যের দাম, সাথে শিপিং ও অন্যান্য প্রক্রিয়াকরণ সম্পর্কিত খরচ কেটে নেবেন।

ধরুন, আপনি শপিফাই দিয়ে ড্রপশিপিং সাইট তৈরি করেছেন। এক্ষেত্রে ‘ওবেরলো মার্কেটপ্লেস’ এবং ‘আলী এক্সপ্রেস’ পণ্য সরবরাহকারী হিসেবে সবচেয়ে ভাল হয়। নবীন ড্রপশিপারদের জন্য এই সাপ্লাইয়ারের কাছে অর্ডার দেয়ার কাজটি প্রথম দিকে সহজই থাকে। কারণ তখন অর্ডারের সংখ্যা থাকে কম।

কিন্তু অর্ডারের পরিমাণ বাড়তে থাকলেই ঝামেলা দেখা দেয়। একই সময়ে একসাথে অনেক অর্ডার আসলে ড্রপশিপার হিমশিম খেয়ে যান। বর্তমানে এই কাজটির জন্য অটোমেশানের বিভিন্ন টুলস যেমন : আফটারশিপ, ওয়াচলিস্ট, বিকেটিং – এসবের ব্যবহার করতে পারেন।

তৃতীয় ধাপ : সরবরাহকারীর বিভিন্ন কাজ

এই ধাপে সাপ্লাইয়ার পণ্যটি শিপিং করেন বা পাঠিয়ে দেন। এক্ষেত্রে সাপ্লাইয়ারের মজুদে পণ্যটিকে থাকতে হবে। দেশে বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বাভাবিক পরিস্থিতি থাকা জরুরী। কোন জাতীয় দুর্যোগে পরিবহনের বিভিন্ন পথগুলো বন্ধ থাকলে সাপ্লাইয়ার পণ্য পাঠাতে পারবেন না। অথবা পাঠানো বেশ সমস্যা হবে।

পণ্যে লোগো বসানো, পরিবহন এবং ভোক্তার হাতে পৌঁছে দেয়ার সমস্ত দায় দ্বায়িত্ব সাপ্লাইয়ারের। ড্রপশিপার, সাপ্লাইয়ারের কাছে সাইন-আপ বা নাম-লেখানোর সময়ই নিজেদের লোগো, ঠিকানা ও অন্যান্য ব্যবসায়িক জরুরী তথ্য প্রদান করে থাকেন। এর ফলে সাপ্লাইয়ার বা সরবরাহকারী পণ্যে, ড্রপশিপারের লোগো বসাতে পারেন, এবং প্যাকেজিং স্লিপে লিখে দিতে পারেন পণ্য ফেরত পাঠানোর ঠিকানা।

ড্রপশিপারকে পণ্যের একটি ট্রাকিং নম্বর দেয়া হয়। ক্রেতার হাতে পৌঁছানো অবধি এই নম্বর দিয়ে পণ্যটিকে ট্র্যাকিং করতে পারেন ড্রপশিপার। এই প্রক্রিয়ার কাস্টমারের কাছে পণ্য পৌঁছানো অবধি ডেলিভারীর বিষয়টির খোঁজ রাখতে পারেন ড্রপশিপার।

আপনার ড্রপশিপিং ব্যবসার পণ্য সরবরাহকারী বাছাই করার সময় এমন কাওকে নিন, যারা সবচেয়ে কম সময়ে কাজ শেষ করার নিশ্চয়তা দিতে পারেন। ড্রপশিপিংয়ের এই ধাপটির ওপরই ড্রপশিপারের নিয়ন্ত্রণ থাকে সবচেয়ে কম। কারণ সমস্তটাই এখানে সরবরাহকারীর ওপর নির্ভর করে। এই ধাপে নিজের আত্নবিশ্বাস বৃদ্ধির জন্য দুটি কাজ করতে পারেন।

  • প্রথম থেকেই আপনার সরবরাহকারীদের একটি যোগাযোগ ও সম্পর্ক রক্ষা করুন। আপনার কাজের গুরুত্ব সমন্ধে তাদের বারবার বলুন।
  • এমন একজন সরবরাহকারী নিন, যিনি তার ক্ষেত্রটিতে প্রতিষ্ঠিত, সুপরিচিত ও স্বনামধন্য।

চতুর্থ ধাপ : ক্রেতার হাতে পণ্য পাওয়া

এই ধাপে ড্রপশিপার ক্রেতাকে জানাবেন যে তার পণ্যের পরিবহন প্রক্রিয়াটি সফল ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ড্রপশিপার ক্রেতাকে তার ট্র্যাকিং নম্বর জানিয়ে দিবেন। এজন্য সাধারণতঃ একটি ইন-বিল্ট ইমেইল ইন্টারফেস ব্যবহার করা হয়। অধিকাংশ ড্রপশিপিং সাইটেই এই ইন্টারফেসটি থাকে।

ড্রপশিপার, পণ্য সরবরাহকারীকে পণ্য পরিবহনের জন্য যে টাকা দিয়েছিলেন, এবং ক্রেতা যে টাকা ড্রপশিপারকে পরিশোধ করলেন এই দুই’এর ব্যবধানটিই ড্রপশিপারের মুনাফা। এখন কোন কারণে যদি সাপ্লাইয়ার, ক্রেতার পরিশোধিত টাকা থেকেও বেশী টাকা নেন, সেক্ষেত্রে ড্রপশিপারের লোকসান হয়।

এই হল ড্রপশিপিং প্রক্রিয়ার চারটি ধাপ। আপনি একটি অর্ডার নিবেন। অর্ডারটি পণ্যের সাপ্লাইয়ারের কাছে পাঠিয়ে দিবেন। তারপর নিশ্চিত করবেন ক্রেতা সেই পণ্য হাতে পেয়েছে। সমস্যা হয় যখন, পণ্য সরবরাহকারী ভুল পণ্য পাঠিয়ে দেন। কাস্টমার কখনই এই সরবরাহকারীকে দেখেন না। তারা শুধু ড্রপশিপারকে চেনেন। তাদের ওয়েবসাইটেই তিনি অর্ডার দেন। এবং তাদের লোগো সম্বলিত একটি প্যাকেজই ক্রেতার হাতে এসে পৌঁছায়। যেকোন সমস্যা হলে তারা ড্রপশিপারকে এসেই ধরবেন। মূল বিক্রেতা- অর্থাৎ সাপ্লাইয়ারকে নয়।

এ কারণেই, সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে নিজের যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রতিটি ধাপের সাথে পূর্ণরূপে জড়িত থাকুন। প্রত্যক্ষ ভাবে এই প্রক্রিয়ার কিছু জিনিস আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে বটে। কিন্তু পরোক্ষভাবে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেমন, আপনি কিন্তু নিজেই আপনার পণ্য সরবরাহকারীকে বেছে নিচ্ছেন।

যদি একবার কোন নির্ভরযোগ্য, ভাল সাপ্লাইয়ার পান তো, তাকে ছাড়বেন না। এরাই আপনার ব্যবসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আপনার সাপ্লাইয়ারকে আপনার ব্যবসার পার্টনার হিসেবে গ্রহণ করে নিন। তাদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করুন।

আপনার অর্ডার ফুলফিলমেন্টে ঝামেলা লাগাবেন না। এবং, অক্ষত অবস্থায় আপনার ফেরত-পণ্য আপনার কাছে পৌঁছে দেবেন, এমন সাপ্লাইয়ার পাওয়া বেশ কঠিনই। যদি কাওকে পান, তার সাথে যেভাবে পারেন সাথে রাখবেন।

আপাততঃ এটুকই। পরবর্তীতে কিভাবে অ্যামাজনে ড্রপশিপিং ব্যবসা করে অনলাইনে আয় করা যায় সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। সুস্থ থাকুন। সততার সাথে কাজ করুন।

Featured Photo by Melanie Lim on Unsplash

Leave a Comment