চুলপড়া বন্ধ করার উপায়

আপনি কী অতিরিক্ত চুলপড়ার সমস্যায় ভুগছেন? আপনি কী ‘চুলপড়া বন্ধ করার উপায়’ খুঁজছেন? আপনার চুলের সমস্যার সমাধান পেতে চাইলে এখনি পুরো লিখাটা পড়ে নিন। আশা করি লেখাটি সম্পূর্ণ পড়ার পর বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করলে অবশ্যই উপকৃত হবেন।

প্রত্যেকটা মানুষেরই সৌন্দর্যের অন্যতম অংশ হলো তার চুল। আর নারীর সৌন্দর্য নিয়ে ভাবতে গেলে এটা বলাই বাহুল্য যে, লম্বা ঘন চুল মানেই ‘চুলে কেশবতী, রূপে রূপবতী’। কিন্তু এই চুল পড়াই এখন নারী পুরুষ উভয়ের মাথাব্যথার মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চুল পড়া বন্ধ করার উপায় হিসেবে অনেকেই অনেক পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। কেউ বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করেন তো কেউ নিজের শ্যাম্পু পরিবর্তন করেন বারবার। আবার অনেকে চুলপড়ার সমস্যা সমাধানে পার্লারেও যান।

কিন্তু, যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য সবার আগে প্রয়োজন সমস্যার কারণ খুঁজে বের করা। চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক চুল পড়ার কারণ, আর সেই সাথে চুলপড়া বন্ধ করার সহজ ও ঘরোয়া কিছু উপায়।

চুলপড়ার কারণ কি?

চুল কমবেশি সবারই পড়ে। হয়তো কারও কম, কারও বেশি। দিনে ৫০ থেকে ১০০টি চুল পড়া স্বাভাবিক। তবে এর বেশি হলেই তা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার চুলপড়া নিয়ে বেশি চিন্তা করলেও কিন্তু চুল পড়ে বেশি। এই চুলপড়া সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য প্রথমেই জানতে হবে কী কারণে চুল পড়ছে।

আপনি কি জানেন, অ্যান্ড্রোজেনিক হরমোন নারীর চুল পড়া ও পুরুষের টাকের সবচেয়ে বড় কারণ? এই হরমোন সাধারণত পুরুষের শরীরেই বেশি পরিমাণে থাকে। তবে মেনোপজের সময় ও পরে নারীর দেহে অ্যান্ড্রোজেনিক হরমোনের পরিমাণ আনুপাতিক হারে বেড়ে যায়। ফলে, হঠাৎ চুল বেশি পড়তে শুরু করে।

এছাড়াও ছত্রাক সংক্রমণ বা খুশকি হলো চুল পড়ার অন্যতম একটি কারণ। আবার, দৈনিক খাদ্যতালিকায় আমিষ, শর্করা, চর্বি, খনিজ ও ভিটামিন পরিমিত পরিমাণে না থাকলেও চুল পড়ে যায়।

আপনি হয়তো জেনে অবাক হবেন, টাক হওয়ার চিন্তাতেও অনেকের টাক হয় ! অর্থাৎ, দুশ্চিন্তায় ভুগলে বা মানসিক সমস্যা থাকলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চুল পড়তে পারে। তবে, দীর্ঘদিন মানসিক দুশ্চিন্তায় থাকলে বা দুশ্চিন্তা কাটিয়ে উঠতে না পারলে অনেক বেশি চুল পড়ে যেতে পারে।

নারীদের ক্ষেত্রে,গর্ভবতী অবস্থায় এবং বাচ্চার জন্মের পর হরমোনাল ভারসাম্য পরিবর্তিত হয় বলে তখন চুল বেশি পড়ে। তবে, হরমোনের এ পরিবর্তন আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেলে পুনরায় চুল গজায়।

চুল ঝরে যাওয়ার কারণগুলো তো জানলেন। আসলে এগুলো আমরা সবাই কমবেশি জানি কিন্তু সেভাবে গুরুত্ত দেই না। কিন্তু যখন চুল ঝরে যেতে যেতে পাতলা হয়ে যায় অথবা অতিরিক্ত চুল পড়া শুরু হয় ঠিক তখন আমাদের টনক নড়ে।

যাই হোক এই ভুলগুলো যাতে আর না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত , আর কিভাবে চুলের যত্ন নিবেন তা জানতে চাইলে পড়তে থাকুন।

৬টি সহজ ও ঘরোয়া পদ্ধতি ব্যবহার করে চুলপড়া বন্ধ করার উপায়


১। নারকেল তেল মালিশ করা (সর্বাধিক কার্যকরভাবে চুলপড়া বন্ধ করার উপায়)

নারকেল তেল মালিশ করলে চুলের স্বাচ্ছন্দ্য ও সজীবতা ফিরে আসে। কারণ নারকেল তেল চুলের পর্যাপ্ত পুষ্টির যোগান দেয়। এটি চুলকে করে মজবুত, নরম, মশৃণ ও আকর্ষণীয়। এটি চুলের ফ্যাকাশে ভাব দূর করে, অতিরিক্ত চুল পড়া রোধ করে, চুলের ঝাকড়া ছাড়াতে সাহায্য করে, মাথার তালুর নরম ত্বক বা স্ক্যাল্ফের ভিতর রক্ত চলাচল বাড়াতে সহায়তা করে।

নারকেল তেল ব্যবহারের পদ্ধতি

স্বাভাবিক তাপমাত্রার নারকেল তেল ব্যবহার করার চেয়ে কিছুটা কুসুম গরম করে ব্যবহার করা উত্তম। এই তেল মাথার স্ক্যাল্ফ সহ সমস্ত চুলে ব্যবহার করা যায়। এই তেল আঙ্গুলের সাহায্যে মাথার স্ক্যাল্ফে ঘষে ঘষে এবং কিছুটা সময় নিয়ে দিতে হয়। কমপক্ষে, সপ্তাহে ২দিন চুলে নারকেল তেল মালিশ করতে হবে।

নারকেল তেলে মেথি ভিজিয়ে রেখে ব্যবহার করলে বেশ ভালো ফল পাওয়া যায়।

২। পেঁয়াজের রস ব্যবহার করে চুলপড়া বন্ধ করার উপায়

পেঁয়াজ এমন একটি উপাদান যার ভিতরে আছে সালফার, যা চুলে রোগ সংক্রমণে বাধা দেয় এবং চুলের ভাঙ্গন ও চুল পড়া রোধ করতে সাহায্য করে। এর মধ্যে আছে মাথার ত্বকে তৈ্রী সকল জীবাণু ধ্বংসকারী অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়া।

পেঁয়াজের রস ব্যবহারের পদ্ধতি

পেঁয়াজ ছেঁচে অথবা পাটায় বেটে প্রথমেই এর রস বের করে নিতে হবে এবং একটি কাপড়ের সাহায্যে রস থেকে এর অতিরিক্ত অংশ আলাদা করতে হবে।তারপর এই রস মাথার ত্বকে ও সমস্ত চুলে আঙ্গুলের সাহায্যে হালকা ম্যাসাজ করে লাগাতে হবে।মাথার ত্বক ঐ রস সম্পূর্ণ শুষে না নেয়া পর্যন্ত চুল বেঁধে রাখতে হবে। অতঃপর যেকোনো শ্যাম্পু দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে।

[বিঃদ্রঃ কাঁচা পেঁয়াজের গন্ধ সরাসরি সহ্য করতে না পারলে এর সাথে যেকোনো সুগন্ধি তেল বা মেহেদী পাতা বেঁটে মিশিয়ে ব্যবহার করতে পারেন।]

৩। গ্রীন টি ব্যবহার করে চুলপড়া বন্ধ করার উপায়

চুলের আগা ফাটা রোধ করে গ্রীন-টি। এর ক্যাফিন নামক উপাদানটি এই কাজটি করতে সহায়তা করে। এতে আরও রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও প্রচুর পরিমাণে পলিফেনোল যা ইউভি নামক ক্ষতিকারক রশ্মির আক্রমণ থেকে চুলকে রক্ষা করে।

চুলপড়া বন্ধ করার জন্য গ্রীন-টি ব্যবহারের পদ্ধতি

গ্রীন-টি ব্যাগ থেকে দানা নিয়ে প্রথমে পরিমাণ মত পানিতে ভালোভাবে ফুটিয়ে নিতে হবে। ফুটানো পানি ভালোভাবে ঠাণ্ডা করে মাথার ত্বকের সমস্ত জায়গায় আলতো হাতে ঘষে লাগাতে হবে।তারপর কিছুক্ষণ রেখে ধুয়ে ফেলতে হবে।

৪। চুল পড়া বন্ধে অ্যালোভেরার ব্যবহার

অ্যালোভেরার আরেক নাম ঘৃতকুমারী যা চুল পরিচর্যার একটি অন্যতম নাম। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি ও ই আছে যা চুলে পর্যাপ্ত পুষ্টি যোগায় ও চুলের গোড়া শক্ত করে। ফলে চুল পড়া সমস্যা দূর হয়।

অ্যালোভেরা ব্যবহারের পদ্ধতি

অ্যালোভেরা পাতার ভিতরের সাদা অংশ (জেল) সরাসরি মাথার ত্বকে ব্যবহার করা যায়। আবার বাজারজাতকৃ্ত জেল ও ব্যবহার করা যায়।

নারকেল বা আমলকি তেলের সাথে অ্যালোভেরা জেল সহযোগে তেল হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

[সতর্কতাঃ কখনো কখনো সরাসরি গাছ থেকে অ্যালোভেরা জেল নিয়ে লাগালে অ্যালার্জি হতে পারে। তাই আগে কিছুটা হাতে লাগিয়ে পরখ করে দেখা উচিৎ]

৫। জবা ফুলের অনন্যতা

ভিটামিন সি ও অ্যামিনো এসিড সমৃদ্ধ জবা ফুল চুল পড়া রোধে অনন্য ভূমিকা পালন করে এবং চুলকে বিভিন্ন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। এটি চুলের শুষ্কতা ও খুশকি দূর করতে সাহায্য করে।

চুলপড়া বন্ধ করার উপায় হিসেবে জবা ফুল ব্যবহারের পদ্ধতি

নারকেল তেলের সাথে জবা ফুল বা জবা ফুলের পাতা মিশিয়ে ব্যবহার করা যায়। এজন্য আগে ঐ ফুল বা পাতা পরিমাণ মত তেলের সাথে মিশিয়ে ভালো করে ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করে নিতে হবে। তারপর সমস্ত মাথায় ও চুলে লাগাতে হবে।

জবা ফুলের পাতা বেটে টক দই এর সাথে মিশিয়েও ব্যবহার করতে পারেন। এক্ষেত্রে এটি ১ ঘণ্টা মাথায় মেখে রেখে শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেললেই ভালো ফল পাওয়া যাবে ।

এছাড়াও কারি পাতা, আঁদা কিংবা পেঁয়াজের রসের সাথে জবা ফুলের রস মিশিয়েও ব্যবহার করা যায়।

৬। চুলপড়া বন্ধে আমলকির ব্যবহার

আমরা জানি যে, আদিকাল থেকেই চুলের যত্নে আমলকির ব্যবহার হয়ে আসছে। চুল পড়া রোধে আমলকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাটি এসিড যা চুলের অন্যতম ঔষধ হিসেবে কাজ করে।

আমলকি ব্যবহারের পদ্ধতি

কাঁচা আমলকির বীজ ফেলে তা রোদে শুকিয়ে সেগুলো নারকেল তেলের সাথে জ্বালিয়ে, ঠাণ্ডা করে ব্যবহার করা যায়।

কাঁচা আমলকির রস সাধারণভাবে নারকেল তেলের সাথে মিশিয়েও ব্যবহার করা যায়। আবার, আমলকির গুঁড়ো সিকাকাই পাউডার ও টক দই এর সাথে মিশিয়েও ব্যবহার করা যায়।

এছাড়া আরও অনেক প্রাকৃ্তিক উপাদান ও বিভিন্ন হারবাল তেল বা শ্যাম্পুও রয়েছে যা বিভিন্ন গাছ-গাছড়া থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে তৈ্রী করা হয় এবং চুল পড়া বন্ধ করে।

[এখানে বলে রাখা ভাল, অনেকেরই চুল পড়ে আগা পাতলা হয়ে যায়। ফলে দেখতে খারাপ দেখায় বলে চুল কেটে ছোট করে ফেলে। কিন্তু এটা মোটেও চুল পড়া বন্ধ করার উপায় নয়। এতে শুধু সাময়িক সুন্দর দেখায়।]

চুলপড়া প্রতিরোধে করণীয়

চুলে তেল দিতে হবে। রাতে তেল দিয়ে সকালে শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেল্লেই আর ত্বক তেল চিটচিটে আর বিরক্তিকর লাগবে না। অথবা গোসলের ৩ঘণ্টা আগে তেল দিতে হবে। অর্থাৎ তেল বাধ্যতামূলক দিতেই হবে।

চুল বাঁধার সময় বেশি শক্ত করে বাঁধা যাবে না।

শ্যাম্পু করার সময় শ্যাম্পুর সাথে পেঁয়াজের রস ও চিনি মিশিয়ে নিলে চুল পড়া প্রতিরোধ হয়। চিনিতে আছে এন্টি অক্সিডেন্ট যা স্কাল্ফের মৃত কোষ সরিয়ে জীবিত ও সজীব কোষকে উপরে আসতে সাহায্য করে। ফলে স্কাল্ফের ভিতর সহজেই বায়ু ও রক্ত চলাচল করতে পারে এবং চুলের গোড়া মজবুত করে।

চিন্তা দূর করতে হবে। চিন্তা দূর হলে মাথা ঠাণ্ডা থাকবে,ঘুমও ভালো হবে। ফলে চুলও পড়বেনা।

বেশি বেশি চুল আঁচড়াতে হবে। যত চুল বেশি আঁচড়ানো হবে চুলের গোড়া তত শক্ত হবে। এতে চুল পড়া প্রতিরোধ হবে ।

সাবান ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সাবানে অতিরিক্ত পরিমাণ ক্ষার রয়েছে। এটা চুলের জন্য ক্ষতিকর। তাই সবসময় শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে।

ভেজা চুল আটকে বা বেঁধে রাখা যাবে না। ভেজা চুল আটকে বা বেঁধে রাখলে চুলের গোড়া ভিজে নরম হয়ে যায়। এতে চুলে হাত দিলেই চুল ঝরে যায়।

ভেজা চুল আঁচড়ানো যাবে না।তখন গোড়া নরম থাকে ফলে চিড়নি দিলেই চুল ছিঁড়ে যায়।

সপ্তাহে ২-৩ বার শ্যাম্পু করা উত্তম।

বেশি আধুনিকতা দেখানোর জন্য বা চুলের সুন্দরতা বাড়ানোর জন্য চুলে হিট দিয়ে টান করা যাবে না বা চুলে রং করা যাবে না। এতে সাময়িক ভাবে সুন্দর দেখালেও চুল পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি বেড়ে যায় ।

বাইরে বের হওয়ার সময় মাথায় ওড়না বা হিজাব পড়ে বের হওয়া উচিৎ যাতে সূ্র্য রশ্মি আর ধূলাবালি মাথার ত্বক রূক্ষ করে চুলের ক্ষতি না করে।

— শেষ কথা —

চুল মানুষের সৌন্দর্য বৃ্দ্ধি করে, আবার এই চুলই মানুষের সৌন্দর্য কমিয়ে ফেলে। চুলের সৌন্দর্য ধরে রাখতে প্রয়োজন সঠিকভাবে চুলের যত্ন নেয়া। সময়মত চুল পরিষ্কার করা, তেল দেয়া, আঁচরানো ইত্যাদির দিকে বিশেষ থেকে বিশেষত্বর খেয়াল রাখা।

আর আপনারা নিশ্চই এতোক্ষণে জেনে গিয়েছেন যে কিভাবে চুলের যত্ন নিবেন। অর্থাৎ কেন চুল পড়ে, চুল পড়া বন্ধ করার উপায় এবং চুল পড়া কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। আশা করি এবার আপনি আপনার চুলের যত্ন সঠিকভাবে নিতে পারবেন।

অবশেষে, আপনার পছন্দমত যেকোনো একটি পদ্ধতি বেছে নিন এবং চুল দিয়ে নিজের সৌন্দর্যকে আরও বিকশিত করুন।

Featured Image by kalhh from Pixabay

Leave a Comment